‘ভীষণ খারাপ’ ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়া জায়েজ!

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 5 May 2012, 12:19 PM
Updated : 5 May 2012, 12:19 PM

আজ এই ব্লগের ব্লগার কালবৈশাখী এর একটা পোষ্ট (ইলিয়াস আলী: যেভাবে ক্যাম্পাসের অস্ত্রবাজ ক্যাডার থেকে ফ্রন্টলাইনে) পড়ে মন্তব্যে কিছু কথা লিখছিলাম। মন্তব্যটা বড় হয়ে যাচ্ছিল বলে ভাবলাম একটা স্বতন্ত্র পোস্টই দেয়া যাক বিষয়টা নিয়ে। বিষয়টা নিয়ে আগ্রহী হলাম এজন্য যে এই ব্যাপারটাকে অনেক পত্রিকা, অনেক ব্লগার এমনভাবে দেখতে চাইছেন যেটা আমাদের সমাজের জন্য একটা বিশাল অশনি সঙ্কেত বলে আমি মনে করি।

আলোচ্য পোষ্টে লেখক ইলিয়াস আলী কী ছিল, কেমন ছিল, কত খারাপ তার অতীত এসব সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। উদ্দেশ্য স্পষ্ট – জনগনকে এই ইঙ্গিত দেয়া যে ইলিয়াস আলীর মত 'ভয়ঙ্কর খারাপ' মানুষ নিখোঁজ হওয়া 'জায়েজ'। ধরে নিলাম লেখকের সব কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি; তার সাথে আরো অনেক অপ্রকাশ্য অপরাধ আছে তার, ধরে নিলাম এটাও। তো সব জেনে কি আমরা ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়াকে 'জায়েজ' বলে ধরে নেব? খুশী হব যে 'ভীষণ খারাপ' একজন মানুষ নিখোঁজ হল? স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবো এজন্য?

লিখাটা পড়ে র‌্যাব বের কথা মনে পড়ল। প্রতিটা ক্রসফায়ারের পর র‌্যাব যেমন বলে মৃত মানুষটি অমুক করেছে, তমুক করেছে, এতগুলো মামলা ছিল ইত্যাদি। তারা দেখাতে চায় যে যেহেতু লোকটি এতো ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী ছিল, তাই তার এভাবে মৃত্যু 'জায়েজ'। আর আমি ব্যক্তিগতভাবে এই দেশের অজস্র বড় বড় সার্টিফিকেটধারীকে (কিন্তু ভেতরে অকাট মূর্খ) দেখেছি এটাকে যুক্তি হিসাবে মানে।

ইলিয়াস আলীর প্রতি আমার কোন প্রীতি তো নেই ই; বরং বিরক্তি, ঘৃণা আছে (পড়তে পারেন ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের আগুনে বদর আলী অঙ্গার )। আমাদের দেশের রাজনীতিকে স্রেফ ধান্দাবাজিতে পরিনত করার জন্য যে ৯৫ শতাংশ রাজনীতিবিদ দায়ী ইলিয়াস তাদেরই একজন ছিলেন বলেই আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু এমন একজন মানুষও কোনভাবেই এভাবে নিখোঁজ হয়ে যেতে পারে না।

সরকার সেটা করার কোন নৈতিক, আইনগত অধিকার রাখে না। প্রধানমন্ত্রীর কথা মত যদি খালেদা জিয়া রাজনৈতিক কারণে করে থাকে এটা তবে তাকে খুঁজে বের করাও সরকারের বিরাট দায়িত্ব। মানবাধিকারের প্রতি ন্যূনতম ধারণা থাকা মানুষ এরকম একটা নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাকে গুরুত্ব না দিয়ে পারে না – নিখোঁজ ব্যক্তি যত খারাপই হোক না কেন। তাই এই মুহূর্তে ইলিয়াস আলী কত খারাপ ছিল সেই আলোচনার চাইতে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা দেশে দীর্ঘদিন থেকে যে গুম চলছে সেটার বিরুদ্ধে আলোচনা, কঠোর অবস্থান।

একজন মানুষ, সে যত খারাপই হোক না কেন তার আইনের (যদিও আইন নিয়েও অনেক কথা বলা যায়) নিয়ম দ্বারা বিচার পাবার অধিকার আছে। কোনভাবেই একজন মানুষ নিখোঁজ (গুম) হয়ে যেতে পারে না। আমি গুমের সব ঘটনাগুলোতে দেখেছি সরকারী সংস্থা স্রেফ অস্বীকার করে যে এটা তারা করেনি। যেমন প্রতিটিটি ক্রসফায়ারের পর র‍্যাবের অস্ত্র উদ্ধারের অভিযানের সময় ক্রসফায়ারের ওই গল্পটি শুনি আমরা। মজার ব্যাপার হল ক্রসফায়ারের সমর্থকরাও এই গল্প বিশ্বাস করে না। তারাও মনে করে এটা স্রেফ 'ঠান্ডা মাথায় খুন'। তাদের সমর্থনের মূল যুক্তি হল যেহেতু ক্রসফায়ারে মৃত মানুষটি ভয়ঙ্কর অপরাধী, তাই………

আমাদের সমাজের এই ভয়ঙ্কর অমানবিক চিন্তা এতোটা জেঁকে বসেছে যে, আমরা এখন কোন অপরাধীকে (চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী) হাতেনাতে ধরে ফেলতে পারলে পিটিয়ে মেরে ফেলি। এসব গনপিটুনিতে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে এই দেশের প্রশাসন কোনদিন কোন ব্যবস্থা নেয়নি। কারণ রাষ্ট্রও মনে করে এটাই হওয়া উচিৎ অপরাধীর পরিণতি। তাহলে তো ভারতীয় বি এস এফ যখন আমাদের দেশের গরু কালোবাজারকারীদেরকে (অপরাধী) গুলি করে মেরে ফেলে সেটাও তো 'জায়েজ'। আচ্ছা আমাদের সরকার কি এজন্যই এই ব্যাপারে কোন উচ্চবাচ্চ করে না?

এই দেশে গত বেশ কিছুদিন থেকে গুমের ঘটনা ঘটে চলেছে। ধরে নিলাম সরকারী সংস্থা এই গুমের ঘটনা ঘটাচ্ছে না। কিন্তু যারা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে তাদেরকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার দায়িত্ব কি সরকারের না? এটা করা গেলে তো এই ধরনের ঘটনা বন্ধ হয়ে যেত। জানি সব অপরাধের কিনারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে করা সম্ভব না। কিন্তু তাই বলে কি একটারও করা যাবে না? হ্যাঁ, আজ পর্যন্ত এমন একটা ঘটনারও বিস্তারিত রহস্যভেদ করে অপরাধীকে ধরে আমাদেরকে জানানো হল না। এটা আমাদেরকে কী ইঙ্গিত দেয়? সাথে যদি বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া মানুষদের পরিবারের মানুষদের কথা শুনি, সেখানে সরকারী আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নাম দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা শুনে ঘটনাগুলো কি মেলানো যায় না?

গোয়েবলসের কথা আমরা জানি। তার নির্দেশিত পদ্ধতিতে মিথ্যাকে বার বার বলে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার পদ্ধতিটি হয়তো কাজ করে কখনো কখনো। কিন্তু র‌্যাবের ক্রসফায়ারের সেই গল্পে এই গোয়েবলসের পদ্ধতিটি কাজ করেনি – মানুষ ওই গল্প 'খায়নি'। তেমনি খাচ্ছে না, খাবে না এতগুলো গুমের সাথে কোন সরকারী সংস্থার জড়িত না থাকার গল্পটাও।

পুনশ্চ: লেখক তুলনামূলক বিচার করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে তাঁর দলে কোন টাউট নেই। বিস্তর লিখা যায় এই বিষয়টা নিয়েও – আমার আজকের লিখার বিষয়টা সেটা ছিল না বলে ব্যাপারটা নিয়ে লিখিনি। আওয়ামী লীগ আর বি এন পির নেতা-সমর্থকরা যখন একজন অপর দলের নেতাকে সন্ত্রাসী-অসৎ বলে গালাগাল দেয়, সেটা দেখে হাসি পায়; মনে পড়ে যায় কথ্য প্রবাদটি "চালুন বলে সুঁচের গায়ে ফুটা"। সময় করতে পারলে ব্যাপারটা নিয়েও লিখবো।