তিস্তা চুক্তি অনিশ্চিতঃ মেরুদন্ডহীনতা আর কত কাল?

জাহেদ-উর-রহমান
Published : 10 May 2012, 07:13 AM
Updated : 10 May 2012, 07:13 AM

রাতে ভাত খেতে খেতে বিবিসি বাঙলার খবর শোনা দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। কাল রাতে ছিল খুব গুরুত্বপূর্ন খবর। তিস্তা চুক্তি অনিশ্চিত – সহসা হবার কোন সম্ভাবনাই নেই। খবরটি এর মধ্যে আমাদের গণমাধ্যমেও এসেছে – 'তিস্তা চুক্তি অনিশ্চিত' । কাল রাতের খবরের পরে ছিল খুব আগ্রহোদ্দীপক একটা সাক্ষাৎকার – ঘটক 'পাখি ভাই' এর; কিন্তু তিস্তা চুক্তির এই খবর শোনার পর সাক্ষাৎকারটা খুব একটা মনযোগ দিয়ে আর শোনা হয়নি।

তিস্তা চুক্তির পরিণতি যে এমন হবে এটা বোঝা যাচ্ছিল মনমোহনের সফরের পর থেকেই। যদিও আমাদেরকে তিন মাসের মধ্যে ওটা হবার গল্প শোনানো হচ্ছিল। আমি অবশ্যই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নই, তবুও আজকের এই প্রেক্ষাপটে ভারত বিষয়ে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির কিছু শিশুতোষ ভুল নিয়ে কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করছে। দীর্ঘদিন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে লিখা পড়ে আর আলোচনা শুনে প্রাপ্ত যৎকিঞ্চিত জ্ঞান নিয়ে এমন বিষয় নিয়ে লিখার দুঃসাহসটা করেই ফেললাম।

শুরুতেই একটা বিষয় পরিষ্কার করে নেয়া ভাল। ভারতের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে আমাদের অনেকেই খুব গদগদ হয়ে আমাদের স্বাধীনতার সময় ভারতের অবদানের কথা স্মরণ করেন। আমাদের স্বাধীনতায় ভারতের সাহায্যের জন্য ভারতকে আমরা ধন্যবাদ জানাই, কিন্তু ওতে এত গদগদ ভাবের কিছুই নেই। ওটা স্রেফ ওদের স্বার্থের জন্যই হয়েছিল – আজন্ম শত্রু পাকিস্তানকে দুই টুকরো করে দিতে পারলে তাদের কৌশলগত লাভ ছিল সীমাহীন। এতে কোন ব্যক্তি বা দলের প্রতি প্রীতি বা মানবিক কোন চিন্তা ছিলনা। আর ওদের চাওয়া যেহেতু আমাদের সাথে মিলে গিয়েছিল, তাই ওটা উভয়ের জন্য জয়ের ব্যাপার হয়েছিল, ব্যাস।

মজার ব্যাপার হল এই ভারতই কিন্তু রাজিব গান্ধীর সময় শ্রীলংকায় তামিলদের ন্যায্য স্বাধীনতা আন্দোলনকে (তামিলদের ঐ আন্দোলন পরে কতোটা ভুল পথে গেছে সেটা ভীন্ন আলোচনা) দমনের জন্য সৈন্য পাঠিয়েছিল, তামিলদের পক্ষে নয়। যার জেরে রাজীবকে প্রাণও দিতে হয়। তাহলে ভারত কি ন্যায্য স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না? না। আসলে ঐ ক্ষেত্রে স্বার্থের হিসাব ছিল ঐ স্বাধীনতার আন্দোলনের বিরোধীতায়, আমাদের ক্ষেত্রে সেটা ছিল সমর্থন করায়। এটাই সাম্রাজ্যবাদী ভারতের কুটনীতি।

এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারত বিষয়ে সরকারের প্রতিটা পদক্ষেপে এটা স্পষ্ট ছিল যে তারা কংগ্রেসের সাথে তাদের 'ঐতিহাসিক সম্পর্ক' এর ভিত্তিতে যাবতীয় সব সমস্যার সমাধান করে ফেলবেন। ভারত বিষয়ক কুটনীতির দায়িত্ব আলাদাভাবে দেয়া হল দু'জন 'ভারত বিশেষজ্ঞ' উপদেষ্টা গওহর রিজভী এবং মশিউর রহমানকে (ইনি বলেছিলেন ট্রানজিটের জন্য ভারতের কাছে ফি নেয়া হবে অসভ্যতা), যাদের কথা বলার ধরন দেখে সরকারের শরীক দলের এমনকি সরকারী দলের অনেক নেতার মুখে শুনেছি যে তাঁরা ঐ দুই উপদেষ্টার কথা শুনে সংশয়ে পড়ে যান যে তাঁরা বাংলাদেশী না ভারতীয়। এমন দুজন উপদেষ্টাকে ভারতের ব্যাপারে দায়ীত্ব দেয়াতেই এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে আমাদের নীতি ছিল ভারতের সামনে নতজানু হয়ে যদি কোন 'ভিক্ষা' পাওয়া যায়।

এরপর থেকে আমাদের দেশ এক তরফাভাবে সব দিয়ে দিতে শুরু করল ভারতকে। ভারতের প্রধান চাওয়াটা কিন্তু আমরা এর মধ্যেই পূর্ন করে দিয়েছি। সেটা ট্রানজিট নয় – তাদের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন (তাদের ভাষ্যমতে) চলছে তার নেতাদেরকে ধরে তাদের কাছে হস্তান্তর করা। ওইসব নেতাদেরকে আমাদের দেশে আশ্রয় দিয়ে কর্মকান্ড পরিচালনা করতে দেয়া সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল কিনা সেটা ভিন্ন আলোচনা। তবে আমাদের সরকার তাদের প্রতিআক্রমণের ভয় থাকার পরও ভারতকে খুশী করেছিল। যদিও আমাদের দেশের শান্তিবাহিনীর পেছনে ভারতের মদদের কথা আমরা ভুলিনি। এবং শান্তিবাহিনী বাংলাদেশ সরকারের সাথে আলোচনার সময় নজিরবিহীনভাবে একটি পক্ষ হিসাবে ভারতের অন্তর্ভূক্তি চেয়েছিল! একই সাথে আমাদের নদীর বুকে বাঁধ দিয়ে, রাস্তার বারোটা বাজিয়ে, একেবারে অপ্রস্তুত আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহার করতে দিয়ে ট্রানজিটের মহড়া হতে থাকল।

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস জেতার পর আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রোটকল ভেঙে মমতা ব্যানার্জীকে ফোন করেছিলেন। সেই সময় উপস্থিত সাংবাদিকদেরকে মমতা খুশীমনে জানিয়েছিলেন তাঁর 'হাসিনাদির' ফোনের কথা। পশ্চিমবঙ্গের দাদাদের জন্য সস্তায় ভাল মানের ইলিশ রপ্তানী করলেন। ভাগ্যের পরিহাস, আজ সেই মমতাই তাঁর 'হাসিনাদির' আর তাঁর সরকারের মুখেই চুনকালি মাখিয়ে দিলেন।

তিস্তার পানি পাওয়া নিয়ে মমতার সাথে আমাদের আলোচনার প্রশ্ন আসে কেন? আমাদের আলোচনা হবে স্রেফ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে। ধরুন আমি করিমের কাছে টাকা পাই, কিন্তু করিম রহিমের কাছ থেকে টাকা না পেলে আমার টাকা দিতে পারবে না – তাই আমার কি উচিত হবে রহিমের হাতে-পায়ে ধরে করিমকে টাকা দিতে অনুরোধ করব যাতে আমি আমার টাকা পাই? কিন্তু ঠিক এই কাজটিই করলেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মমতার সাথে দেখা করে তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন চুক্তির ব্যাপারে রাজী হতে। এটা প্রমাণ করল ভারতের সামনে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটির মেরুদন্ড বলে কিছু নেই।

আরো একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল – তিস্তা চুক্তিকে ট্রানজিটের সাথে মিলিয়ে ফেলা। মনমোহনের সফরের সময় যখন তিস্তা চুক্তি হল না, আমরাও ট্রানজিটের চুক্তিতে সই না করে বেশ বাহবা নেয়ার চেষ্টা করলাম। কাল বিবিসির খবর অনুসারে ভারতও বলতে চেষ্টা করল তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় তারা এখন সম্ভবত ট্রানজিট পাবে না; তাই তারা মায়ানমার হয়ে বিকল্প পথে ট্রানজিটের কথা ভাবছে। এতে কিন্তু চমৎকারভাবে তিস্তা চুক্তি ট্রানজিটের সাথে মিলে গেল। অথচ তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা নৈতিক এবং আইনগতভাবে আমাদের অধিকার। কিন্তু ট্রানজিট মোটেও সেটা নয়। দিলেও সেটা আমাদের 'দয়া'। ভারতকে ট্রানজিট না দিলেও তিস্তার পানি তাদেরকে দিতেই হবে।

অবাক হই ভেবে আওয়ামী লীগের সাথে কংগ্রেসের 'ঐতিহাসিক সম্পর্ক' কোনকালে কী করেছে এদেশের জন্য? বঙ্গবন্ধুর সময় সেই ছিটমহল বিনিময়ের সময় আমরা আমাদেরটা দিয়ে দিলাম, আর ভারত তাদের সংবিধান সংশোধন করছি করব বলে কাটিয়ে দিল ৪০ বছর। 'অন টেষ্ট' চালু করা ফারাক্কা হয়ে রইল মরন ফাঁদ হয়ে। এই ঐতিহাসিক সম্পর্ক আমাদের দেশকে কাটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলা বন্ধ করতে পারেনি। পারেনি সীমান্তে গুলি করে মানুষ মারার উৎসব ঠেকাতে। এই 'ঐতিহাসিক সম্পর্ক' শুল্কমুক্ত পন্যের সংখ্যা বাড়ানোর আইওয়াশ দেয়, কিন্তু নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ারের মাধ্যমে একটা পন্যকেও ঠিকমত ঢুকতে দেয় না। এই সম্পর্কের সুত্র ধরে ঘুর্ণিঝড় আইলার সময় প্রতিশ্রুত চাল দিতে গড়িমসি করতে করতে শেষে পচা চাল পাঠানো হয়। আর টিপাইমুখ বাঁধ আর আন্তনদী সংযোগের কথা শুনলে তো ভয়ে অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়।

আমার মত অতি সামান্য জ্ঞানের মানুষও এটা বোঝে যে আন্তর্জাতিক কুটনীতিতে আবেগের কোন স্থান নেই – এটা জাষ্ট স্বার্থের দরকষাকষি, বিনিময়। ভারতের ক্ষেত্রে এটা আরো সত্য। এমন রাষ্ট্রকে আমরা বিশ্বাস করেছি মানে আমাদের এই সরকারের নীতিনির্ধারক এবং পরামর্শদাতারা সব আহাম্মক। সেই আহাম্মকির মাশুল দিলাম আমরা তিস্তা চুক্তির এই পরিণতি দেখে।

চুক্তিটা না হওয়ায় আমি কিছুটা খুশিই হয়েছি। আমি আশংকা করছিলাম ভোটের রাজনীতির জন্য যেনতেনভাবে একটা চুক্তি সরকার করে ফেলতে চাইতে পারে যেন ওটা দিয়ে মানুষকে আই ওয়াশ দেয়া যায়। বগল বাজিয়ে করা 'গ্যারান্টি ক্লজহীন' ফারাক্কা চুক্তি আমাদেরকে কী দিয়েছে সেটা দেশবাসী জানে। বাজে চুক্তির চাইতে চুক্তি না হওয়া ভাল – পরে ভাল একটা চুক্তি হবার সম্ভাবনা থাকে।

গত তিন বছর আক্ষরিক অর্থে ভারতকে কুর্নিশ করে, ভারতের সামনে আমাদের মেরুদন্ডহীনতা দেখিয়ে আমরা পাইনি তেমন কিছুই। আমাদের কি শিক্ষা হয়নি এখনো? আমি মনে করি কুর্নিশ করে কিছু পাবার আশা আর না করে 'অন্যভাবে' চেষ্টা করা উচিত আমাদের। সেই 'অন্যভাবে'টা কোনপথে হতে পারে, আমাদের এখনকার আলোচনা হওয়া উচিত সেটা নিয়ে।