এই আমাদের জীবন?

জহিরুল চৌধুরী
Published : 26 March 2015, 08:26 AM
Updated : 26 March 2015, 08:26 AM

তারুণ্যে একজন লুঙ্গি পড়া নেতার বক্তৃতা শুনতাম। তিনি আমাদের চট্টগ্রামের ন্যাপ নেতা মাওলানা আহমেদুর রহমান আজমী। আর এই প্রবাসে সেদিন লুঙ্গিপরা আরেক মাওলানার বয়ান শুনলাম। বয়ানের মূল কথা এরকম- জীবনকে আমরা কোথায় নিয়ে চলেছি? সকাল থেকে রাত দুপুর পর্যন্ত আমরা ব্যস্ত। দম ফেলার সুযোগ নেই যেন? কিন্তু ব্যস্ততা কিভাবে কেড়ে নিয়েছে আমাদের সব মানবিক মূল্যবোধ? তিনি সুধালেন- প্রাক ইসলামী যুগে মানুষের জীবন যাত্রা। মানুষ ফজরের নামাজ পড়ে জীবনের ফিকির করত জোহর পর্যন্ত। জোহর থেকে আসর পর্যন্ত বিশ্রাম নিত। আসর থেকে মাগরেব পর্যন্ত প্রতিবেশীর খোঁজ তথা সামাজিক যোগাযোগ করত। মাগরেব থেকে এশা পর্যন্ত সন্তান-সন্ততি ও পরিবারের সান্নিধ্যে কাটাত। বাকিটা সময় নিদ্রা যেত।

আমার সন্তান রোজ সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় দেখে আমি টেবিলের উপর ল্যাপটপ তুলে বসে আছি। স্কুল থেকে ফিরেও দেখে ল্যাপটপেই। একদিন ক্লাসে শিক্ষক তাকে জিজ্ঞেস করলেন- তোমার বাবা কি করেন? আমার ৯ বছরের সন্তানের জবাব ছিল- বাবা সারাদিন ই-মেইল লেখে। এটাই তার কাজ! কথাটা অসত্য নয় মোটেও। হ্যাঁ, প্রতিদিন অন্তত এক ডজন ই-মেইল লিখি, জবাব আসে সিকি ভাগের। পরের দিন আরো ই-মেইল লিখি ডজন খানেক, একইভাবে জবাব আসে সিকি ভাগের। এটাই আমার পেশা, এটাই আমার কাজ। তবে আমি যে একেবারেই বিশ্রাম-আনন্দ করি না, তা নয়। প্রায় আধাঘন্টা-এক ঘন্টা হলেই আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে শারীরিক কসরত করি। মোবাইলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখে ঘন্টাখানেক হাটাচলা করি নিজের বাড়ির ক্যাম্পাসেই।

আমার কাজের কোনো বাধাধরা নিয়ম নেই। আমার কাজের প্রত্যক্ষ কোনো বস নেই। তবে মনের কোনে এক বসের আসন আমি তৈরি করেছি। তার কাছে প্রতি রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে প্রশ্ন করি- আজ আমি কি 'হালাল' করেছি আমার উপার্জন? যদি সামান্য গাফিলতিও থাকে পরদিন, এমনকি সপ্তাহান্তের ছুটির দিনেও আমি যে করেই হউক সেটি যেন পুষিয়ে দেই। তবে আমার এই ল্যাপটপের পাশেই মোবাইল ফোনে ক্ষনে ক্ষনে মানুষ (সোর্স)-এর সঙ্গে যোগাযোগ করি। ভাইবার, হোয়াটস অ্যাপ, স্কাইপে কত কি? কেবল মোবাইলের ওয়ার্ল্ড ক্লকে মিলিয়ে নিই বেইজিং, মেলবোর্ন, সিঙ্গাপুর, দুবাই কিংবা ঢাকার সময়। সময়ে এই ল্যাপটপেই বাংলাদেশের একাত্তর, চ্যানেল২৪ ইত্যাদির খবর শুনি, আর ই-মেইল লিখি। সোর্সিং এর পাশাপাশি প্রায়ই টক শো'র পাঁচালিও বাদ যায় না। অনলাইন এবং কাগুজে পত্রিকাও পড়ি এই ল্যাপটপেই।

আরেকটি ক্ষুদে যন্ত্র দানব মোবাইল ফোনের খপ্পরে আমরা কতোটা জড়িয়ে গেছি খেয়াল করুন। কুড়ি বছর আগে যখন কেবল ভূমি ফোন (ল্যাণ্ড লাইন) ছিল, তখন সারাদিনে দু'চারটির বেশি কল আমরা ধরতে পারতাম না। যে কলগুলো ব্যস্ততার আড়ালে থেকে যেত, সেসবের জন্য আমাদের কোনো আফসুসও থাকত না। এখন খেয়াল করুন মোবাইল ফোনের কল্যানে আমরা প্রতিদিন কতটি কল ধরি। আর যেগুলো ধরতে পারিনা, সেগুলোর জন্য অপর প্রান্তের কাছে আমরা কতবার 'সরি-সরি' বলি! কারন এখন যারা কল করে, এবং কল রিসিভ করে সবারই জানা- মোবাইল ফোনটি হয় কানের সঙ্গে সেট করা, নয়ত পকেটে। কাজেই কল রিসিভ না করার সুযোগ আদৌ আছে কি?

আমার একটি পারিবারিক লাইব্রেরি আছে, এখানে। তাতে হাজার পাঁচেক বই। কিন্তু লাইব্রেরীতে কবে কখন ঢুঁ মেরেছি বলতে পারব না। সব লেখাপড়া এই কম্পিউটারেই। কম্পিউটারই আমার দশ হাতের দুর্গা। কম্পিউটারের মাইক্রোচিপসের মত নিজের মেধাকেও যন্ত্রের ভেতর আস্টেপিস্টে বেঁধে নিয়েছি। বছর তিনেক আগে টাইম ম্যাগাজিনের একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছিল- 'আমরা কি দিনে দিনে কেবল ওয়্যারি হয়ে যাচ্ছি?' সম্প্রতি আমি লক্ষ্য করেছি- আমার পরিবারের চারজন মিলে হয়ত টিভিতে কোনো একটি মুভি দেখছি, কিন্তু একই সঙ্গে ছেলেটি ব্যস্ত ট্যাবলেট নিয়ে গেইমে, মা-মনি ব্যস্ত ল্যাপটপে, আমি মোবাইলে, স্ত্রীও মোবাইলে। দিনে দিনে আমরা অভ্যস্থ হয়ে পড়ছি মাল্টি ট্যাস্কিং-এ। কিন্তু এটা কি কোনও শুভ লক্ষণ? এতে করে কি নিখাদ আনন্দ আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে না? কখনো এমনও হয়- ল্যাপটপে দেখছি বাংলাদেশের সংবাদ, একই সঙ্গে আবার ওদিকে সিএনএন-এ দেখছি আমেরিকার সংবাদ! কোনটা ছেড়ে কোনটা রাখি! অথচ আমিই আমার সন্তানকে বার-বার বলি- 'ডু ওয়ান থিং অ্যাট এ টাইম'!

মাল্টি ট্যাস্কিং নিয়ে গার্ডিয়ান পত্রিকায় ড্যানিয়েল জে লেভটিন সম্প্রতি (১৮ই জানুয়ারি) মূল্যবান একটি আর্টিক্যাল লিখেছেন। তাতে তিনি বলেছেন- এটি আমাদের মগজকে নস্ট করে দিচ্ছে! বিখ্যাত ম্যাসাচুসেট ইন্সটিটিউট অব ট্যাকনোলজি'র একজন গবেষকের উধ্রিতি দিয়ে তিনি বলেছেন-'যখনই আমরা কোনো ই-মেইল লিখি, অথবা এর জবাব দেই, তখন আমরা মনে করি আমরা কিছু একটা করেছি। যখনই ফেইসবুক-টুইটারে স্ট্যাটাস আপ-ডেট করি তখন ভাবি আমি হয়ত কিছু একটা ভাল কাজ করেছি। মনে করি আমি সামাজিকভাবে আরো বেশি সংযুক্ত হয়েছি। কিন্তু ভুলে যাওয়া চলবে না যে এটা গাধার উপলব্ধি। এ গুলোর মাধ্যমে আমরা যে তৃপ্তি ও আনন্দ পাই, তা প্রকৃত আনন্দ ও তৃপ্তির চেয়ে ঢের নগণ্য! বাস্তবে এসবকে নিউরাল এডিকশন ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না!'

এটি যে নিউরাল এডিকশন তা আর চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে বলার প্রয়োজন পড়ে না, যখন দেখি- চীনের গুয়াংজুতে ৩০ বছর বয়স্ক যুবক কম্পিউটারে গেইম খেলতে খেলতে তিন দিন পর মৃত্যুমুখে পতিত হয়! কোরিয়ার দেইগুতে আরেকটি যুবক ৫০ ঘন্টা একাধারে ভিডিও গেইম খেলে যখন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়, তখনই সে কেবল ক্ষান্ত হয়!

নিউইয়র্ক, ২৫ মার্চ ২০১৫