হরপ্পার খরা

জহিরুল চৌধুরী
Published : 25 June 2015, 04:20 AM
Updated : 25 June 2015, 04:20 AM

…………….
নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন সাম্প্রতিক তাপদাহে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ভারতে সহস্রাধিক লোকের মৃত্যু ঘটেছে। গতকালের সিএনএন ও আলজাজিরার সংবাদ। আজ পাকিস্তানের ডন পত্রিকা বলছে একমাত্র পাকিস্তানেই মারা গেছে ৮৩০ জন! ইউনিসেফ বলছে ভারতের ১২টি রাজ্যে অন্যূন ১৩ কোটি লোক খরা ও তাপদাহে আক্রান্ত। গত এক'শ বছরেও নাকি এমন খরা আসেনি। একই অবস্থা পাকিস্তানে। ৩০ লাখ লোক মানবিক বিপর্যয়ের শিকার। বেশীর ভাগ মৃত্যু অবশ্য পাকিস্তানেই। তাপদাহের কারনে হাজার হাজার মানুষের বাস্তুচ্যুতির আশংকা। গড়ে ৪৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস বাঁ তারও উপর তাপমাত্রায় পাকিস্তান সরকার অবশ্য করাচি ও আশেপাশের এলাকায় জরুরি অবস্থা জারি করেছে।

সিন্ধু অববাহিকার হরপ্পা-মোহেঞ্জোদারো পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার পীঠস্থান। মনে করা হয় খ্রীস্ট পূর্ব ৬ হাজার বছর আগে থেকেই পঞ্চ নদের তীরে মানুষ সভ্যতার আলো ছড়িয়ে ছিল। মানুষের কৃষিকাজ ছিল। ছিল তামা, ব্রোঞ্জ, সোনা-রূপার ব্যবহার। আজো আমাদের দেশ্‌ বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে যে গরু গাড়ির প্রচলন, তা উত্তরাধীকার সূত্রে আমরা পেয়েছি হরপ্পার মানুষের কাছ থেকে।

কিন্তু এই সভ্যতার পতন সম্পর্কে আমাদের ছোটকালে ইতিহাস বইয়ে পড়েছিলাম- ইন্দোইউরোপীয় আর্যরা এসে অনার্যদের তাড়িয়ে দিয়েছিল। সেই অনার্যরা নেমে এসেছিল নামায়, গাঙ্গেয় বদ্বীপে। আজ বিজ্ঞানের কল্যানে প্রমাণিত হয়েছে- যে কয়েক জন ইন্দো-ইউরোপীয় সেখানে এসেছিল, তাদের সঙ্গে স্থানীয়দের কোনো যুদ্ধ হয়নি। স্বাভাবিক কারনেই তাদের মৃত্যু হয়েছিল। বরং হরপ্পা-মোহেঞ্জোদারোর যে মানুষগুলো গাঙ্গেয় বদ্বীপে নেমে এসেছিল জীবন বাঁচাতে, তার অন্যতম কারন ছিল প্রকৃতির বিরূপ খেয়াল। তাপদাহ, খরা, ক্ষুদ্র এলাকায় জনসংখ্যার বিস্ফোরণ, মারাত্মক খাদ্য ঘাটতি ইত্যাদি।

তখনও ছিল পানির তীব্র অভাব। সভ্যতার ইতিহাস খুঁড়ে নৃতত্ত্ববিদরা পেয়েছেন- হরপ্পার ধনী লোকেরা ঠিকই সারাবছরের পানি মজুত রাখতেন, এমনকি তাদের বাড়ির আঙ্গিনায় ছিল বিশালাকায় হাম্মাম। কিন্তু গরীবের পানির সংস্থান ছিল না। পানিতে ভাসতে-ভাসতেও মানুষ বাঁচতে পারে। কিন্তু পানি ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারেনা। তীব্র খরায় এমনকি সরস্বতী নদী পর্যন্ত কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। অথচ ঋগ্বেদে আছে- সরস্বতী নদী ছিল ব্রহ্মপুত্রের মতই প্রমত্তা। অবশ্য অতি সম্প্রতি নাসার পাঠানো তথ্য চিত্র নিয়ে গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা সরস্বতীর অস্তিত্বও আবিষ্কার করেছেন। এই সরস্বতী ছিল সিন্ধু নদের পাশাপাশি। এরও উৎপত্তি হিমালয় থেকে, আর মিলন আরব সাগরে।

আমাদের প্রিয় বাংলাদেশেও থর মরুভূমি থেকে তাপদাহ আসে মে-জুন মাসে, কিন্তু তা জীবন কেড়ে নেয় না। পদ্মা, মেঘনা, যমুনার শীতল জলের পাশাপাশি দক্ষিণের খোলা সমুদ্র আমাদের দিয়ে যায় উদ্দাম বাতাস। শীতকালে উত্তরের পর্বতমালা আমাদের রক্ষা করে সাইবেরিয়ার হিম প্রবাহ থেকে। বরং গঙ্গা-যমুনা, ব্রহ্মপুত্রের তট ধরে হাজার বছর ধরে আগত অভিবাসীদের স্বাগত জানিয়েছে বাংলাভূমি। আজ একই তাপদাহ-খরার মুখোমুখি হয়ে এই হতভাগ্য হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো, সভ্যতার পাদপীঠের এই মানুষরা আশ্রয় নেবে কোথায়? আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ সর্বত্রই যে আমরা আজ সীমানার প্রাচীর তুলে রেখেছি?

নিউইয়র্ক, ২৪ জুন ২০১৫

প্রথম ছবি পাকিস্তানের প্রভাবশালী দৈনিক ডন পত্রিকায় আজ প্রকাশিত