তারপরও ঈদ আসে

জহিরুল চৌধুরী
Published : 18 July 2015, 08:13 AM
Updated : 18 July 2015, 08:13 AM

উৎসব আনন্দকে আতলামির ঘোরে দূরে ঠেলে দেয়ার মত নিরস আমি নই। অনেক দুঃখ-বেদনাকে পায়ে ঠেলে আনন্দকে নিংড়ে নিতে চাই একশত ভাগ। আমার দেশের প্রান্তিক মানুষ আমি। ঘরে খাবার না থাকলে, পরনে ছিন্ন বস্ত্র থাকলেও ঈদের দিনটি মনে হয় অন্তত আনন্দে কাটবে। এই প্রবাসে আমাদের ঈদ আসে এখনও ঠিক আগের মত।

ঈদের জন্য আমার স্ত্রী কাজ থেকে ছুটি নিয়ে নেয় আগের দিন থেকে। শুরু হয় পিঠা-পায়েস, ফিরনি-পোলাও রাঁধার আয়োজন। এটা নেই, সেটা নেই উপলক্ষে আমাকেও ছুটতে হয় এ দোকানে, সে দোকানে। তারপর পেঁয়াজ কাটো, রসুন বাটো, আদা বাটো, সব কাটাকাটির ঝামেলা আমার ঘাড়ে। ঘুমোতে ঘুমোতে সেই রাত একটা। ঘুম থেকে উঠতে হয়েছে সকাল সাড়ে সাতটায়। ছেলেমেয়ে, সবার গোসল সেরে ঈদের নামাজের উদ্দেশে ছুটে চলা সাড়ে আটটায়। প্রতিবছর ঈদে নতুন পাঞ্জাবী-পাজামা। কোত্থেকে, কিভাবে জোগাড় হয় আমি নিজেও জানিনা। আমার স্ত্রীকে জীবনে একটাই ঈদের শাড়ি কিনে দিয়েছিলাম ১৬'শ টাকায় বিয়ের প্রথম বছরে, বোনাস পেয়ে। তারপর ভুলে গেছি ঈদে নতুন জামা-কাপড় কেনার প্রয়োজনীয়তা। এমনকি বাচ্চাদের জন্যও!

আমাদের এখানে ঈদের জামাত হয় পাচতারা হোটেলের বলরুমে। হাজার-বারো'শ মানুষ হয়। অন্তত ৫'শ গাড়ি পার্কিং-এর ব্যবস্থা হোটেল ছাড়া আর কোথাও সম্ভব হয় না। মসজিদগুলো বড় হলেও শ'দুয়েকের বেশি পার্কিং হয় না। তো ঈদের নামাজ পড়েই অনুজ মিয়ার বাড়িতে সকালের নাস্তার আয়োজন। নাস্তা, অতঃপর ফটো সেশন শেষ করে ডাক্তার মোহাদ্দিস সাহেবের বাসায় ফের নাস্তার দাওয়াত ছিল। মোহাদ্দিস সাহেব মুসল্লী প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু ঈদের দিনেও কর্মস্থলে আছেন জেনে তাকে ফোন করলাম। জানালেন- তিনি হার্টের ডাক্তার বলে বেশিরভাগ বয়স্ক মানুষ তার রোগী। আর এসব বয়স্ক মানুষ তাকে দেখাতে আসেন অন্তত ১৫-২০ দিন থেকে এক মাস আগে সময় করে। ঈদের দিন যেহেতু আগে থেকে নির্দিস্ট করা ছিল না, সেকারনে ডাক্তার সাহেব সেসব রোগী দর্শন বাতিল করেননি। বাতিল করলে তারা কষ্ট পাবে! ডাক্তার সাহেবের এই যুক্তি শুনে মনে মনে ভাবলাম- আমাদের বঙ্গ দেশের ডাক্তাররা যদি এমন রোগী দরদী হতেন!

দুপুরে খাবার খেতে যাব প্রতিবেশী স্বপন ভাইয়ের বাসায়। নিজের বাসায় কখন খাওয়া হবে জানি না। তবে কয়েক জনকে বলেছি রাতে আসতে। রাতে সবাই এলে গান-বাজনার আসর বসাবো। কারাওকিতে যে যার মত করে গাইবে। গান-বাজনার তোড়ে আমি আবার খাবার-দাবারও ভুলে যাই। আমার মন খারাপ হলে তিনটির যেকোনো একটি করি- হয় লিখি, পড়ি, নাহয় মনের সুখে কারাওকিতে গান গাই। নিজের গানের নিজেই শ্রোতা।

কাল যুক্তরাষ্ট্রের একটি ঘটনা মনকে খারাপ করে দিল। কুয়েতি বংশোদ্ভূত এক সালাফী-ওয়াহাবি মতাবলম্বী যুবক চার মার্কিন সেনাকে গুলি করে হত্যা করেছে টেনেসি'র মেরিন রিক্রুটিং সেন্টারে। হত্যাকারী ইউসেফ আব্দেল আজিজ তার ফেইসবুক স্ট্যাটাসে বলেছে- এই হত্যার বিনিময়ে নাকি তার জন্য বেহেশত নির্ধারিত! এদিকে গত সপ্তায় সিলেটে নিহত রাজনের কান্নাজড়া মুখের দিকে তাকালে বিষাদে ভরে ওঠে মন। আজ তারও ঈদ করার কথা ছিল। বালকটি আমাদের সবার প্রতি ভেংচি কেটে চলে গেল। তার হত্যাকারীদের জন্য সৃষ্টিকর্তা কি বরাদ্ধ রেখেছেন আমার জানা নেই। এদের জন্যই কবি লিখেছিলেন- "কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক কে বলে তা বহুদূর। মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরাসুর।" বাংলাভাষায় লেখা এমন মধুর কথা পৃথিবীর আর কোনো ভাষায় আছে কিনা আমার জানা নেই।

এতো দুঃখের মাঝেও সুখবর- আজ নিউইয়র্কে সরকারি ছুটির দিন- মুসলমানের ঈদ উপলক্ষে। ইতিহাসে এই প্রথম। নিউইয়র্কের মেয়র আগেই ঘোষণা করেছিলেন- পুর্ব নির্ধারিত থাকলে মুসলমানের ঈদ উপলক্ষ্যে একদিন ছুটি দিতে তার আপত্তি নেই। সরকারি এই ঘোষণায় একটি লাভ হয়েছে- মুসলমানেরা ফেতনা ফ্যাসাদ ভুলে একই দিন ঈদ উদযাপনে শামিল হয়েছে। আগে সৌদি ও পাকিস্তানী মুসলমানেরা পৃথক দিনে ঈদ করত। তাতে বাংলাদেশীদের মধ্যেও বইত বিভক্তির সুর! মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য আসুক শুভ ও কল্যানের পথে, অসাম্প্রদায়িকতা হউক জীবনের পাথেয়, এই প্রার্থনা আজকের দিনে।