মাসাধিক সময় ধরে ফেইসবুকে কোনো লেখালেখি নেই। আন্দাজ করতে পারছিলাম এই প্রবাস বিজনে কাজের তোড়ে শেকড়ের সঙ্গে যোগাযোগ আলগা হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু না, জাফর ভাই আবার বাধ্য করলেন লেপটপের কী বোর্ডে হাত রাখতে।
জাফর ভাই আমার চেয়ে বয়সে ২৫ বছরের বড়। কিন্তু কখনো এই ব্যবধানকে বাধা মনে হয়নি আমাদের বন্ধুত্বে। এখনও যেমন পঁচিশ বছরের কোনো তরুনকে বন্ধু ভাবতে কুন্ঠিত হইনা। যেদিন প্রথম জাফর ভাই'র বনানী'র বাসায় যাই, সেদিন বাড়ির দেয়ালে 'সিনো-বাংলা' কর্পোরেশনের সাইন বোর্ড দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলাম। আটপৌরে রাজনীতিবিদ কি করে নির্ঝঞ্জাট ব্যবসা বাণিজ্যে মশগুল থাকতে পারেন! গল্পের মাঝে মাঝেই জাফর ভাই চায়না থেকে চাল আমদানীর বিষয়ে কথা বলছিলেন টেলিফোনে। জিজ্ঞেস করেই ফেলেছিলাম- এটা কি আপনার ব্যবসা? এই বিস্ময় আরও বাড়িয়ে দিলেন- এক দুপুরে জাফর ভাই নিয়ে গেলেন "চায়না ডাক" নামের একটি রেস্তোরাঁয় বনানীতে। জানলাম, এই বিশাল রেস্তোরাঁয়ও তার অংশীদারি আছে!
জাফর ভাই এক সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন, এরশাদ জমানায়। এ নিয়ে তার গর্ববোধ ছিল। মওদুদ, শাহ মোয়াজ্জেমকে ডিঙ্গিয়ে ক্ষণকালের জন্য হলেও এরশাদের আস্থাভাজন হয়েছিলেন। এরশাদ জেলে থাকা অবস্থায় মিজান চৌধুরীর নেতৃত্বে জাপা পুনর্গঠিত হলেও নেতৃত্বে কুনুইয়ের গুঁতোগুঁতি ছিল মারাত্মক পর্যায়ে! এবং এই ঠেলাঠেলির পরিণতিতেই কাজী জাফরের নেতৃত্বে পৃথক জাপা'র আত্ম প্রকাশ! কাজী জাফরকে বহুদিন বলতে শুনেছি ব্যারিস্টার মওদুদকে উদ্দেশ্য করে- আমি ছিলাম বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী, আর তুমি ছিলা ভাইস প্রসিডেন্ট!
এক সময়ের চীনা পন্থী সমাজতন্ত্রী রাজনীতিবিদ কি করে স্বৈরশাসকের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলেন, এ নিয়ে গবেষকরা গবেষণা করবেন। তাঁর অনুষঙ্গ রাশেদ খান মেননও যেমন আজ আওয়ামী লীগের জটাজালে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছেন! সমাজতন্ত্রের এই ভড়ং বাদ দিলে ক্ষমতার প্রশ্নে এঁদের মধ্যে বিন্দু মাত্র তফাত নেই। মিজান, মওদুদ, মোয়াজ্জেম, কাজী জাফর সবাই একই ডেকচির ভাত। আর এদেরকে এক ডেকচিতে শামিল করার কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন এরশাদ।
জাফর ভাই'র কাছে বহু রাজনৈতিক গল্প শুনেছি। দু'টি গল্প এখনও মনে গেঁথে আছে। জিয়া হত্যাকারী জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা ছিল। মঞ্জুরের চরিত্রের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন- এমন অস্থির এবং প্রাণবন্ত মানুষ তিনি জীবনে কমই দেখেছেন। ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে খুবই উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক উদারতার কিছুই ধারন করেন না বলে হতাশা ব্যক্ত করতেন কাজী জাফর। একটি গল্প ছিল এরকম- ভাসানী তখন জেলে, ঈদের ক্ষণে। কাজী জাফর নেতার জন্য লুঙ্গি-পাঞ্জাবী নিয়ে গেছেন জেল গেটে। কাজী জাফরকে উদ্দেশ্য করে ভাসানী বললেন- তোমারটা আমি পরবো ঈদের পরদিন। ঈদের দিন পরতে হবে মুজিবের দেয়া পাঞ্জাবি।
সাংবাদিকতা করলেও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আমার সব সময় সম্পর্ক ছিল অম্ল মধুর। কেবল কাজী জাফরের সঙ্গেই সে সম্পর্ক মধুরতার সীমা অতিক্রম করেছিল। বক্তৃতার মঞ্চে যেমন তাঁর ছিল বাঘের গর্জন, তেমনি বৈঠকী কাজী জাফর ছিলেন ক্ষীণ কন্ঠের মধুর ভাষী। বন্ধুত্বের সূত্রে জাফর ভাই'র কাছে আমি চিরঋণী। একবার হবিগঞ্জে সমাবেশ করতে গেলে জাফর ভাই হঠাত উপস্থিত আমাদের বাড়িতে। সেদিন বিকেলে আমাদের বাড়ির বারান্দায় জাফর ভাইকে ঘিরে শত মানুষের স্রোত সামাল দেয়া ছিল সত্যি কঠিন কাজ। আরেকবার, আজ থেকে সতের বছর আগে তাঁর মৃত্যুর দিনটিতে (২৬ আগস্ট) যেদিন আমার প্রথম সন্তান জন্ম নিল, জাফর ভাই শোনা মাত্র মোস্তফার হাতে পাঁচ হাজার টাকা গিফট পাঠিয়েছিলেন। জীবনে সেই প্রথম এবং শেষ- কোনো রাজনীতিবিদের দেয়া উপহার গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করতে পারিনি। কারন তিনি ছিলেন- মনেপ্রাণে মেহনতি মানুষের বন্ধু জাফর ভাই। চির বিদায়, লাল সালাম।
নিউইয়র্ক, ২৮ আগস্ট ২০১৫
ছবিঃ বিডি নিউজের সৌজন্যে