আন্তর্জালের মৃত্যুদূত !!

জহিরুল চৌধুরী
Published : 21 June 2011, 06:41 PM
Updated : 21 June 2011, 06:41 PM

ফরাসি বিপ্লবের আগে পরে ফ্রান্সে মৃত্যুদণ্ডের যে গিলোটিন ব্যবস্থা চালু ছিল, সেটি ছিল খুবই দ্রুত এবং নিশ্চিত। লন্ডনে মাদাম তুসোর মিউজিয়মে এমন একটি গিলোটিন এবং মৃত্যুদণ্ডের র‌্যাপ্লিকা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। গিলোটিনের খ্যাচাৎ শব্দের আগে মাত্র সেকেন্ডের জন্য শোনা যায় মানুষের আর্ত চিৎকার! পরবর্তিতে মৃত্যুদণ্ডের যে লেথাল ইঞ্জেকশন প্রথা চালু হয়, যা আমেরিকার কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে এখনো প্রচলিত, সেটিও আরও দ্রুত এবং কার্যকর। কোন আওয়াজ নেই, তবে ইঞ্জেকশনের মূহুর্তে মানুষের দেহটি একটু কেঁপে উঠে। ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিক চ্যানেলের বদৌলতে অনেকে হয়তো সেটি দেখে থাকবেন টিভি পর্দায়। সৌদি আরবে জুম্মার দিনে প্রকাশ্যে জল্লাদের তরবারির আঘাতে যে মৃত্যুদণ্ডের বিধান এখনো কার্যকর, প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে শুনেছি সেটিও খুবই দ্রুত এবং নিশ্চিত- বলা যায় চোখের পলকে মানুষের মাথা ধড় থেকে আগলা হয়ে যায়, কোন আওয়াজ ছাড়াই। কিন্তু হাল আমলে কূ শাসকদের জন্য মৃত্যু পরোয়ানা তামিল করার জন্য সৃষ্টি হয়েছে যে অন্তর্জাল- ইংরেজীতে ইন্টারনেট, সেটিও ততোধিক দ্রুত ও নিশ্চিত।

এই অন্তর্জালের বদৌলতে মানুষ আজ দ্রুত এবং নিশ্চিতভাবে পৌঁছে যাচ্ছে সত্যের কাছাকাছি। তথ্যের সহজলভ্যতা এবং সত্যতা মানুষকে করে তুলছে সাহসী! তাকে মুখাপেক্ষি হতে হচ্ছে না কোন কর্পোরেট হাউজের প্রকাশিত সত্য-মিথ্যার দলিল 'নিউজ পেপার' কিংবা কোন টিভি চ্যানেলের পর্দায়! মিডিয়ার কথা বলায় অনেকে রাগ করতে পারেন। কিন্তু কি আশ্চর্য বাংলাদেশে কেন, হাল আমলের আধুনিক বিশ্বে কোথাও যে সাংবাদিকের স্বাধীনতা নেই সে কথাতো বলে গেছেন বাংলাদেশের প্রধান একটি মিডিয়া হাউজের মালিক সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন! নিঃশঙ্ক চিত্তে তিনি একদিন বলেছেন, বাংলাদেশে সাংবাদিকের স্বাধীনতা নেই, স্বাধীনতা আছে পত্রিকা মালিকদের।

বাংলাদেশের কথা বাদ, এই সিএনএন- ক্যাবল নিউজ নেটওয়ার্ক, নামের নীচে লগো ব্যবহার করে লিডার অব দ্যা নিউজ। কয়েক মাস আগে মুখের কথার উপর চাকরি নট করে দিলো রিখ সেনচেজের। যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলীয় সময় বিকেল তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত রিখের অনুষ্ঠানটি ছিল খুবই জনপ্রিয়। কারন টুইটার, ফেইসবুকের মাধ্যমে দর্শকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ গড়ে তুলতেন এই কিউবান ইমিগ্র্যান্টের সন্তান।

তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে অবস্থান নিয়েছেন গুয়ানতানামো বে' এবং ইরাকের আবু গারিব কারাগারে বন্দি নির্যাতনের বিরুদ্ধে, কিংবা দু®কৃতকারী মুসলিম হলেই ইসলামিক টেররিস্ট আখ্যায়িত করার বিরুদ্ধে। তার দৃঢ় অবস্থান ছিল টেক্সাসে ইমিগ্র্যান্ট বিরোধী আইন পাশের বিরুদ্ধে। যে আইনের মাধ্যমে পুলিশকে ইমিগ্র্যান্টদের ব্যাক গ্রাউণ্ড যাচাই করার অধিকার দেয়া হয়। সর্বশেষ তার চাকরি নট হওয়ার অন্যতম কারন ছিল তিনি কথা বলতে শুরু করেছিলেন ওয়াশিংটনের লবিস্ট এবং স্পেশাল ইন্টারেস্ট গ্র"পের বিরুদ্ধে!

দ্রুত এবং নিশ্চিত। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চট্টগ্রাম মহানগরীতে যাবার সময় ট্রেনের ডানদিকে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম পাহাড়ের গায়ে এ শব্দযুগল দেখার জন্য। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের ভেতর পাহাড়ের গায়ে কে কখন যে এ শব্দ দুটি উৎকীর্ণ করেছে তা আমার অজানা। কোন সৈনিক তো বটেই যে কোন মানুষের জীবন বিন্যাসে দ্রুত এবং নিশ্চিত হওয়ার প্রয়োজন যে কত বড় তা আজ এই ইন্টারনেটের যুগে টের পাচ্ছি হাড়ে-হাড়ে। তবে একজন সংবাদকর্মীর জীবনেও আমি সব সময় মনে রেখেছিলাম এ শব্দ দুটির কথা। নিউজ রুমে বার্তা সম্পাদকের রক্তচক্ষু দেখার আগেই নিজের দু'কলম রিপোর্ট পৌঁছে দিতে চেষ্টা করতাম তার টেবিলে।

পাঠক মনে করুন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সৃষ্টির জন্য সময় লেগেছে পুরো চার বছর। প্রায় ৬০ বছরের ব্যবধানে অনুরূপ আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়তো আজ প্রয়োজন পড়বে চার দিন, চার সপ্তাহ কিংবা বড়জোর চার মাস। বাঙালিকে শোষণ-শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে সময় লেগেছিল ২৪টি বছর। আজকের দিনে হয়তো সময় লাগতো ২৪টি সপ্তাহ কিংবা বড়জোর ২৪ মাস! ১৯৮২ থেকে '৯০, নয় বছর সময় লেগেছে সামরিক স্বৈরাচারের কবল থেকে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে। আজকের দিনে হয়তো সময় লাগতো ৯ সপ্তাহ অথবা নয় মাস। সামনের দিনগুলো আরো সংকীর্ণ! হাতের কাছে লেপটপ আর ইন্টারনেট পেয়ে গেলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো এতো সময় নেবে না।

একটি ভিডিও ক্লিপে দেখছিলাম ক্লে সার্কি'র বক্তৃতা, সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর। কিভাবে আমাদের জীবন ধারা বদলে দিচ্ছে আজকের ইন্টারনেট! চলতি মিসর এবং ক'দিন আগের তিউনিসিয়ার ঘটনা এই ইন্টারনেটের কপালে জুড়ে দিয়েছে সাফল্যের রক্ত তীলক। তাই ইন্টারনেট আজ কূ শাসন এবং কূ শাসকদের জন্য মৃত্যু পরোয়ানা ছাড়া কিছু নয়। যেখানেই গণতন্ত্র হয়ে যাচ্ছে অসাঢ়, সেখানেই সরব হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া। অবশ্য দু'টি দেশেই ইন্টারনেটচারীর সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার যথাক্রমে ২৫ ও ৩৩ শতাংশ!

প্রায় দু'শ বছরের ছাপাখানার যুগ পেরিয়ে মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল টেলিগ্রাফ এবং টেলিফোন। এরপর এলো ফটোগ্রাফি, সাউণ্ড রেকর্ডিং এবং মুভি। অতঃপর রেডিও-টিভি। গত প্রায় কুড়ি বছর ধরে একচেটিয়া রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে ইন্টারনেট। এই ইন্টারনেট কেবল লেপটপ কিংবা ডেস্কটপেই নয়, এখন মোবাইল ফোনেও। এক আন্তর্জালিক বিশ্বে দ্রুত বদলে যাচ্ছে মানুষের সামাজিক এবং রাজনৈতিক মূল্যবোধ। মানুষ আর একা এবং বিচ্ছিন্ন নয়। ভালবাসা, বিরহ, সাহস আর সংগ্রামে মানুষ খুঁজে পাচ্ছে তার নিকট জন। মানুষের এই একত্রিত হওয়ার পেছনে কোন ইমোশন কাজ করছে না, কাজ করছে তথ্য এবং তথ্যাদির বিপুল ভাণ্ডার!

ক্লে সার্কি উদাহরণ হিসেবে টেনে এনেছেন ২০০৮ সালের ১২ মে চীনের সিচুয়ান প্রদেশে ৭ দশমিক ৯ ম্যাগনিচ্যুডের ভয়াবহ ভূমিকম্পের কথা। এতে মারা যায় ৭০ হাজার মানুষ, নিখোঁজ হয় ১৮ হাজার, আর ক্ষতিগ্রস্থ হয় অন্তত দেড়কোটি মানুষের জীবন-যাপন। অথচ এই ভূমিকম্পের খবরটি বিশ্ববাসীর সামনে সর্বপ্রথম উপস্থাপন করে কোন এক ইন্টারনেটচারী টুইটার এবং চায়নিজ পোর্টার কিউ-কিউ-এর মাধ্যমে। বিবিসি প্রথম সংবাদটি পরিবেশন করে টুইটারের বরাত দিয়ে। চীনের সরকার ভূমিকম্প সম্পর্কে জ্ঞাত হয় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা জিনহুয়ার আগে কোন এক নাগরিকের ইন্টারনেট ক্লিপিং-এর মাধ্যমে। টুইটারে ছবিসহ সংবাদটি প্রকাশের অন্তত ৭ মিনিট পর যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভে তাদের ওয়েব সাইটে সংবাদটি পরিবেশন করে। অথচ এর আগে ১৯৭৬ সালে তেংশান ভূমিকম্পে ২ লাখ ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু হলেও বিশ্ববাসী তা জেনেছিল প্রায় তিন মাস পর।

বাংলাদেশের বন্যা এবং উপকূলে ঘূর্ণিঝড়ের কথাই ধরুন না। সাম্প্রতিক কালের ঘূর্ণিঝড়গুলোর মানুষের মৃত্যু এবং ঝুঁকির পরিমান অনেক কমে গেছে কেবল মোবাইল ফোন মানুষের মুঠোয় চলে গেছে বলে। অথচ পাঠক মনে করুন- মোবাইল ফোনকে হাতের মুঠোয় পেতে বাংলাদেশকে কত না রাজনৈতিক এবং আমলাতান্ত্রিক বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে! ইন্টারনেটের মাধ্যমে মানুষ সঠিক তথ্যের আদান-প্রদান করতে পারলে তার ভবিষ্যত সে নিজেই নির্ধারণ করতে সক্ষম হবে, এটাই যুগের প্রত্যাশা। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি- বাংলাদেশে ইন্টারনেটচারীর সংখ্যা এখনো হাতে গোনা।

ওয়ার্ল্ড স্ট্যাট-এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ইন্টারনেটচারীর সংখ্যা বর্তমানে দশমিক ৬ শতাংশ। ২০০০ সালে তা ছিল দশমিক ১, ২০০৭-এ দশমিক ৩ এবং ২০০৯-এ দশমিক ৪ শতাংশ। বৃদ্ধির এ হার অব্যাহত থাকলে ধারনা করা হচ্ছে ২০২০ সাল নাগাদ ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা ২ কোটিতে পৌঁছবে। বর্তমানে ইন্টারনেটচারীর সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। তবে আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৭ শতাংশ। ১১৭কোটির দেশে ইন্টারনেট ব্যবহার করে ৮ কোটির ওপর। চীনে প্রায় ৩২ শতাংশ, ১৩৩ কোটির দেশে ইন্টারনেট ব্যবহার করে অন্তত ৪২ কোটি। অবশ্য আমাদের চেয়ে দরিদ্র আফগানিস্তান কিংবা নেপালেও ইন্টারনেটচারীর সংখ্যা আমাদের চেয়ে বেশি, অর্থাৎ ৩ দশমিক ৪ এবং ২ দশমিক ২ শতাংশ। বাংলাদেশে ইন্টারনেটচারীর সংখ্যা অন্তত ১০ শতাংশে পৌঁছে গেলে আমরা ধরে নেবো কোন বদ লোকের পক্ষে ক্ষমতায় আসা এবং টিকে থাকার স্বপ্ন একেবারে ধূলিস্ম্যাৎ হয়ে যাবে। এ কারনেই হয়তো সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বৈশ্বিক অন্তর্জালে অন্তর্ভূক্তির ব্যাপারে আমাদের নেতা-নেত্রীদের এতোটা অনীহা ছিল!

ইন্টারনেটে পিছিয়ে থাকলেও মোবাইল ফোনে আমাদের অগ্রগতি ঈর্শনীয়! বাংলাদেশের ৬টি মোবাইল কোম্পানি কেবল ২০১০ সালেই গ্রাহক যুক্ত করেছে অন্তত ১ কোটি ৬০ লাখ। সরকারি কর্মকর্তাদের মতে মোবাইল ফোন খাতে বছরে ৩১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশকে এ অঞ্চলে সবচেয়ে দ্রুততম প্রবৃদ্ধির টেলিকম মার্কেটে পরিণত করেছে। বর্তমানের ৬ কোটি ৮৬ লাখ মোবাইলসেবীর সংখ্যা আগামী পাঁচ বছরে ছাড়িয়ে যাবে ১২ কোটিতে।

অতএব যারা রাজনীতির গায়ে কলঙ্ক লেপন করে দেশে-বিদেশে বসে ক্ষমতার স্বপ্নে মূহ্যমান, তারা হয়তো এবার ভেবে দেখবেন বিষয়টি স্বপ্নের মতো এতো সোজা নয়। যে বাঙালী মেবাইল ফোনের মাধ্যমে বন্যা-দুর্যোগকে মোকাবেলা করতে শিখেছে, আগামী দিনের রাজনৈতিক দুর্যোগকেও তারা মোকাবেলা করতে সক্ষম সমভাবে। তা হয়তো রাজনীতিবিদদের জন্য হতে পারে আরো নির্মম!

***
৫ ফেব্রুয়ারি, নিউইয়র্ক
আমার এ লেখাটি আগে প্রিয়.কম ব্লগে প্রকাশিত হয়েছিল, পড়ার জন্য ধন্যবাদ