রাজনীতিবিদের পরিণাম এবং ভূত তাড়ানোর গল্প

জহিরুল চৌধুরী
Published : 9 July 2011, 04:47 PM
Updated : 9 July 2011, 04:47 PM

কথা হচ্ছিলো জয়নাল আবেদীন ফারুকের পুলিশের হাতে নাজেহাল হওয়ার বিষয়ে। এটি নিউইয়র্ক নগরী থেকে ৮০ মাইল উত্তরে একটি গ্রামের ঘরোয়া আসরে। আসরে স্রোতা ও বক্তা মিলিয়ে ১৭/১৮ জন। আইবিএম, এবং আইবিএমের বাইরে প্রত্যেকে নিজ-নিজ কর্মক্ষেত্রে সমুজ্জল। সপ্তাহান্তে শুক্র-শনিবার সন্ধ্যের আসর থেকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ বাদ যাবে, এটি কখনো কেউ আশা করেন না। তবে আলোচনা শুরু হয় প্রথমে আমেরিকা নিয়ে। এখানকার জব মার্কেট, রাজনীতি, সমাজ জীবনের নানা দিক, ওবামা'র দ্বিতীয় মেয়াদে আসার সম্ভাবনা, চীনের সঙ্গে আমেরিকার রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে পেরে ওঠার বিষয়টি থেকে সর্বশেষ দক্ষিন সুদানের রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভাবের সম্ভাবনা- কিছুই বাদ যায় না আলোচনা থেকে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রসঙ্গ আসতেই সবাই গা ঝারা দিয়ে ওঠেন। কারন একটাই- আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা আর বেঁচে থাকা বাংলাদেশ ঘিরে। এবং একই সঙ্গে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে বাংলাদেশের অস্তিত্ব চিরঞ্জীব রাখার বিষয়টিও আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের রাজনীতি মানেই পচা-গলা, রদ্দি, কেবলই দুর্গন্ধ ছড়ায়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ অপার সম্ভাবনা আর সাহসের প্রতিক। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষার জন্য সংগ্রাম, এবং স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষের কপালে চিরদিনের জন্য এঁকে দিয়েছে সম্ভাবনার রক্ত তীলক। একটি দেশের রাজনীতি, তার জনগনের প্রাত্যহিক জীবনের তাগিদ থেকে কতটা যোজন দূরে অবস্থান করতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাংলাদেশ।

১৯৯০ সালে গণতান্ত্রিক অভুত্থানের পর থেকে রাজনীতির এই উল্টো যাত্রা বাংলাদেশকে একটি সম্ভাবনার রাষ্ট্র থেকে কতোটা উল্টো পথে নিয়ে গিয়েছে, তা দেখে আমরা কেবল বিস্মিত আর হতবাক হই। জনগনের জীবন মান উন্নয়নের পরিবর্তে প্রতিহিংসার এক কুজ্জটিকা বাংলাদেশের রাজনীতিকে নিয়ে যাচ্ছে আফ্রিকা'র সুদান অথবা সোমালিয়ায়। সবার মুখে একই প্রশ্ন- বাংলাদেশের ক্ষণ ভঙ্গুর গণতন্ত্র টিকে থাকবে তো? নাকি আরেকটি ওয়ান-এলেভেন অনিবার্য হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশে?

জয়নাল আবেদীন ফারুকের রাজনীতিবিদ হয়ে উত্থানের পর্বটি আমি নিজ চক্ষে দেখেছি ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ থেকে। আমার এগারো বছরের সাংবাদিকতায় পঞ্চম থেকে সপ্তম, জাতীয় সংসদের কোন একটি অধিবেশনও বাদ দেইনি। বাংলাদেশে সন্ত্রাসী, মাসল্ম্যান থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠার অনেক নজির আছে। জয়নাল আবেদিন ফারুককে এদের থেকে আলাদা করা যাবে না। জাতীয় সংসদে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা থেকে শুরু করে নোয়াখালীর সেনবাগে জনৈক শিক্ষক তাকে সালাম না দেয়ায় শিক্ষকের গালে চপেটাঘাত- এধরণের অসংখ্য শিরোনামে ভূষিত আমাদের এই স্বনাম ধন্য চীফ হুইপ। আমাদের দেশে হাসিনা-খালেদা'র আশীর্বাদে কত নর্দমার কীট অমানুষ যে ভাগ্যের বরপুত্রে পরিণত হয়েছে তার তালিকা দিয়ে শেষ করা যাবে না। গত প্রায় দুই যুগে এই দুই নারীর সীমাহীন দাপট এবং অবিবেচনা প্রসূত কাজ বাংলাদেশকে আজ বিশ্বের মানচিত্রে গজ মূর্খের দেশে পরিণত করেছে। এসব মূর্খের অপরিণামদর্শী কার্যকলাপে বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ সমাজ জীবন আজ বিপণ্ন। ফারুকের ঘটনা সে ধরনেরই একটি।

তথাপি কোন মানুষকে রাস্তায় এভাবে পেটানো যে কতোটা কুরুচিপূর্ণ তা দর্শক মাত্রই অনুভব করেছেন, যারা ঘটনাটি দেখেছেন টিভি পর্দায়। আবার কেউ কেউ বলেছেন- পুলিশেরও ধৈর্যের সীমা আছে। সংসদে তিনি যেমন কুরুচিপূর্ণ ভাষা ব্যাবহার করেন, একই ভাষা তিনি ব্যাবহার করেছেন সেদিন পুলিশের ওই কনস্টেবলের প্রতি। মানুষ রাজনীতিবিদের প্রতি যে ভাষা এবং আচরণ আশা করে তা না পেলে পরিণাম কি হতে পারে, জয়নাল আবেদিন ফারুক সম্ভবত তার জাজ্বল্যমান উদাহরণ। ঢিল মারলে পাটকেলটি খেতে হয়, তাতো পুরনো বাংলা প্রবাদ! তবে আশ্চর্য হয়েছি আমাদের সৈয়দ আশরাফ সাহেবও যে ইদানিং চাকরি রাখার প্রয়োজনে হাসিনার ভাষায় মূর্খ কথা বলতে শুরু করেছেন! ফারুকের মার খাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছেন- আমাদের নাসিম সাহেবও তার চেয়ে বেশি মার খেয়েছিলেন। মূর্খ আর কাকে বলে?
তবে আমার লেখাটি শেষ করছি নোয়াখালী'র একটি ভূত তাড়ানোর সত্য গল্প দিয়ে। গল্পটি বলেছেন সম্প্রতি আইবিএম থেকে অবসর নেয়া আমাদের ড. আব্দুল্লাহ ভাই। ৬০-এর দশকে তার চাচিকে একবার ভূতে ধরেছিল রাতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলে। ভদ্র মহিলা ঘরে ঢুকেই মেঝেতে মূর্ছা যান। এরপর আবোল-তাবোল বলতে শুরু করেন। এমন কথাবার্তা বলতে শুরু করেন বিজ্ঞের মতো, যা তিনি আগে কোনদিন বলেন নি। ভূত তাড়ানোর জন্য মোল্লা মতন ওঝা ধরে আনা হলো। মোল্লা কোরানের আয়াত জপের পাশাপাশি মহিলার পিঠে আমের ডাল দিয়ে চাপটাতে লাগলো। এসময় মহিলা আবার বিজ্ঞের মতো বলে উঠলেন- "পিঠরে তুঁই মাররে ক্যা, পিঠর কি দোষ। খোঁপাত ধরি ছোবাত কিলা, ছোবার যত দোষ!!"

***
৯ জুলাই ২০১১, নিউইয়র্ক