একটি বইয়ের গল্প

জহিরুল চৌধুরী
Published : 17 August 2011, 07:47 AM
Updated : 17 August 2011, 07:47 AM

বইটি ছিল আমাদের পারিবারিক পাঠাগারে, মাঝামাঝি কোন একটি র‌্যাকে। পারিবারিক পাঠাগার বলতে আড়াইটি শেলফে হাজার দশেক বই। পাঠাগারটির জন্ম দিয়ে আমার সেজো ভাই এর নাম দিয়েছিলেন- 'অন্বেষা'।

সেজোভাই'র অনুপস্থিতিতে এর দেখভাল করতাম আমিও। কাজেই বইটি শেলফে রাখার সময় আমার দৃষ্টি ছিল।

বড় পা'র বিয়ের সময় ১৯৭৬ সালে বইটি উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন আমাদের পাড়ার মুনীর মোস্তফা প্রফেসর, স্থানীয় বৃন্দাবন কলেজের। বই আসলে এক জোড়া- প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড। কিন্তু একেবারে কড়কড়ে ছিল না। মনে হলো আগে-ভাগে কেউ পড়ে দিয়েছে। বইয়ের মাঝে-মাঝে পাতার ভাজও ছিল। বিশেষত আমি প্রফেসর মোস্তফাকে চিনতাম আগে থেকে। আমাদের শহরের স্থানীয় লিটল ম্যাগাজিনে সবসময় লিখতেন কবিতা কিংবা গল্প। কলেজে প্রাণী বিজ্ঞানের অধ্যাপক হলেও খুব বড় একজন পড়–য়া। এ জন্য বই দুটো পড়ার ব্যাপারে আমার আগ্রহ ছিল।

আমি নিশ্চিত ছিলাম- পড়ার মতো দুটো বই। কিন্তু পড়ার সামর্থ আমার ছিল না। প্রথম খণ্ড নিয়ে নাড়াচাড়া করে, দু-একটি পাতা পড়ে আবার রেখে দিয়েছি। বিয়ের উপহার হিসেবে রাশান বাংলা বই, আমাদের সমাজে একেবারে বেমানান। সাধারণত অজিফা, বেহেশতি জেওর, সেরাতুল মোস্তাক্বিম ধরনের বইই বিয়েতে উপহার দেয়া হয়। তা না হলে বড় জোর রবীন্দ্র, নজরুল, শরৎ অথবা গোলাম মোস্তফার রচনাবলী থেকে। কাজেই আমাদের বাড়ির কেউ কখনো বই দুটো পড়ে দেখেনি। কারন মস্কো প্রকাশনীর বইয়ে এমনিতে আগ্রহের মাত্রা কম। প্রথমত মলাট আকর্ষণীয় নয় বলে, দ্বিতীয়ত অনুবাদ নিম্নমানের। পড়তে গেলে দাঁত আটকে যায়।

দরিদ্র পিতার ঘরে জমজ বোনের মতো বই দুটো শেলফে পড়ে থাকে চরম অবহেলায়। ধুলো-ময়লা পড়ে, আমি ঝাড়নি দিয়ে পরিষ্কার করি। ঝাড়নির গুঁতো খেয়ে এক সময় বাঁধাইয়ের নীচের দিকে কিছু অংশ ছিড়ে যায়। আঠা দিয়ে ছেড়া অংশ জোড়া লাগানোর চেষ্টা করি। কোনক্রমে পড়া যায় দূর থেকে বইয়ের টাইটেল- 'ইস্পাত'।
লেখক নিকোলাই অস্ত্রভস্কি।

আমার বয়স বারো, কিন্তু শরৎচন্দ্রের রচনা সমগ্র প্রায় শেষ করার পথে। কৃষ্ণকান্তের উইল, শ্রীকান্ত, গৃহদাহ, দেবদাস, পথের পাাঁচালী, পরিণীতা কষ্ট করে পড়ে নিয়েছি। সে বছর আমাদের শহরে একুশের একটি লিটল ম্যাগাজিনে গল্প লিখলাম- 'মৃণালীর কন্ঠি'।

শরৎচন্দ্রের প্রভাব স্পষ্ট। কিন্তু ইস্পাত পড়ার জন্য অপেক্ষা করলাম আরো ছয়টি বছর।

১৯৮২ সালের প্রথম ভাগে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি প্রথম বর্ষের ছাত্র। ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে গেল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কারনে। হলগুলোও বন্ধ করে দেয়া হলো। বাড়িতে ফিরে এলাম। হাতে অফুরন্ত সময়। একদিন ধুলো মুছে প্রথম খণ্ডটি হাতে নিলাম। প্রথম দু-চার-আট পাতা কিছুই বুঝলাম না। কোন আগ্রহই জন্মালো না। বার বার অনুবাদকের নাম দেখি। আর মনে মনে বলি প্রকাশনি সংস্থা অনুবাদের মানুষ পেল না! এভাবে ২০-২৪টি পাতা পড়ে ফেলার পর বুঝতে পারলাম এর কাহিনী আসলে কোন দিকে গড়াচ্ছে। এরপর এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা, এবং দুটো খণ্ডই। প্রায় সাড়ে চারশো পৃষ্ঠা মাত্র দুই কি তিন দিনে!

বইতো নয় যেন জ্বলন্ত আগুণ। বই পড়তে যেয়ে আমার ভেতরটা মড়-মড় করে উঠলো। শরীরটা ঘেমে গেল, আমি কিসের যেন আওয়াজ শুনতে পেলাম! আরো ভালোভাবে বললে চট্টগ্রামের আনোয়ার রি-রোলিং মিলের জ্বলন্ত রড, ছুটছে আর চারপাশে ছিটিয়ে যাচ্ছে জ্বলন্ত স্ফুলিঙ্গ! লোহার আকড়ের মতো আমার জীবনটাও বদলে গেল। বদলে গেল আমার চিরাচরিত বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি আর চিন্তার দিক রেখা। বইটি পড়ে যেন নেয়ে উঠলাম, আর নিজেকে আবিষ্কার করলাম একজন অন্য মানুষে। হ্যাঁ আমি বদলে গেছি। আমার চারপাশের মানুষ- বাবা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সব বদলে গেছে। বদলায়নি কেবল আমার চির স্নেহ প্রসবিনী মা। মায়ের হাসি এখন আমার কাছে আরো জীবন্ত, আরো গভীর আরো মর্মস্পর্শী। মায়ের হাসি পলকে রেখে আমি বদলে দিতে পারি গোটা বিশ্ব। আমার শক্তি অসীম, হারকিউলিসও হার মানবে এ শক্তির কাছে!

বইয়ের নায়ক হয়ে গেছি আমি নিজে পাভেল করচাগিন। ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লব, ১৯১৮ সালে রাশিয়ায় জার্মান সৈন্যের আক্রমণ আর রাশিয়ার গৃহযুদ্ধে আমি এক নির্ভিক সৈনিক। চৌদ্দ বছরের আমি পাভেল পালিয়ে, ছুটে বেড়াচ্ছি আমার কৈশোরের প্রেমিকা তানিয়ার হাত ধরে। গৃহযুদ্ধের মধ্যেই আমি পদার্পণ করেছি যৌবনে। আমি কাজ করছি রেস্টুরেন্টের উনুনে, কখনো রেলওয়ের ইলেক্ট্রিশিয়ান হিসেবে। বলশেভিকদের ক্যাম্পে আমার রাত কাটছে অনিদ্রায় আর আতঙ্কে। তথাপি আমি স্বপ্ন দেখি। আমার স্বপ্নের জাল বিস্তৃত হয় দারিদ্র্য, অনাহার আর সামাজিক অবিচারের ভেদবুদ্ধি ঠেলে। আমি ভালবাসতে শিখি মানুষকে। মানুষের নীচতা আর অবিমৃস্যকারিতাকে পায়ে দলে আমি এগিয়ে যাই আমার গন্তব্যে! আমার সংস্পর্শে যারা আসে তারাই বদলে যায়! আমার আমি হয়ে যাই শতে-হাজারে!

বইয়ের লেখক নিকলাই অস্ত্রভস্কি তার জীবনীকেই এঁকেছেন এ বইয়ে। স্পন্ডিলাইটিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান মাত্র ৩২ বছর বয়সে। জীবনের শেষ আটটি বছরের প্রথম চার বছর ছিলেন অন্ধ হয়ে। লাইন সোজা রাখার জন্য তার স্ত্রী তাকে কাগজ সেটে দিতেন কাঠের খাজ কাটা বোর্ডে। আর শেষের চার বছর তার দিন কাটে একেবারে বিছানায়। অন্ধ আর পঙ্গুত্বে জড়াজড়ি করে। ইস্পাত বইটির মূল নাম 'হাও দ্যা স্টিল ওয়াজ টেম্পার্ড'।

বইটি অনূদিত হয়েছে শতাধিক ভাষায় আর পেয়েছে রাশিয়ার সর্বোচ্চ খেতাব লেনিন অর্ডার। আরেকটি বই 'বর্ণ অন দ্যা স্টর্ম' শেষ করতে পারেননি। ইস্পাত ছায়াছবিতেও রূপান্তরিত হয়েছে রাশিয়ায় সেই ১৯৩৫ সালে। রূপান্তরিত হয়েছে ৬টি টিভি সিরিজে রুশ টেলিভিশনে ১৯৭৫ সালে। সর্বশেষ চায়নার উদ্যোগে ২০০০ সালে এ বইয়ের আলোকে আরেকটি টিভি সিরিজ নির্মিত হয় 'হাও দ্যা স্টিল ওয়াজ টেম্পার্ড' নামে। স্থান-কাল-পাত্র ঠিক রাখার জন্য বইয়ের পাত্র-পাত্রী আনা হয় ইউক্রেন থেকে। আমি সিরিজটি দেখার অপেক্ষায় রইলাম।

***
১৯ই জানুয়ারি, ২০১১, নিউইয়র্ক
লেখাটি অন্য একটি ব্লগে প্রকাশিত হয়েছিল