আবহাওয়া বলতে যে শব্দটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত, আমেরিকার ক্ষেত্রে তা একেবারেই বেমানান। আমেরিকার ক্ষেত্রে যুতসই শব্দটি হলো "ওয়েদার"।
যে কখনো কথা শোনে না, কিংবা নিয়মকানুন মানে না। বাংলাদেশে আবহাওয়া বলতে আমরা বুঝি- গরম একটু বেশি কিংবা কম, অতিবৃষ্টি কিংবা বন্যা। শীত অথবা ঘন কুয়াশা। আর বাদবাকি দিনগুলো- বসন্তের মৃদুমন্দ হাওয়া, গ্রীস্মের কাঠাল পাকা রোদ, মেঘ মেদুর বরষা, শরতের শিশির, হেমন্তের খেজুরের রসে, কিংবা শীতের আমেজে কোথায় যে পালিয়ে যায় টেরও পাওয়া যায় না। আমেরিকায় "ওয়েদার" টের পাওয়া যায় হাড়ে হাড়ে। শীত যেমন আসে কাঁপিয়ে, গ্রীষ্মও বেড়ায় তাড়িয়ে।
আমেরিকায় অস্থায়ী বসতের ১০ বছর। কিন্তু এখনো জুন-জুলাই-আগস্ট মাসে পার্কে কিংবা নদীর ধারে বাংলাদেশের আবহাওয়া'কে খোঁজার বৃথা চেষ্টা করি। সকালে ৬০ ডিগ্রী ফারেনহাইট তো দুপুর গড়ালে ৮০ ডিগ্রী। মধ্য জুলাইয়ে দিন শুরু হলো ভোর তিনটেয়, তো রাত আসতে-আসতে সেই সাড়ে ন'টা। শীতের দিনে আরো চমক। জানুয়ারি মাসে মধ্য দিনে যদি ২০ ডিগ্রী ফারেনহাইট, রাতে তা দাঁড়াবে মাইনাস ২০-এ। উত্তর আর দক্ষিনের বায়ূ খেলা করে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। কেউ হারতে চায় না। মাঝখানে প্রাণীকূলের তেরোটা বাজার উপক্রম! বর্ষায় শুরু হয় পাতা লাল হওয়ার মাধ্যমে, নভেম্বরের মধ্যে সব পাতা পড়ে গাছগুলো নেংটো, ভরা শীতে গাছপালা শুকিয়ে কাঠ, আবার এপ্রিল থেকে শুরু হয় গাছে গাছে নব কিশলয়ের। টিউলিপ আর ডেফোডিলের বাহারে জেগে ওঠে চারপাশ। এই বুঝি বসন্ত, কিন্তু তখনো পুরোমাত্রার মাঘ মাস। মে-জুন মাসে মনে হবে বাংলাদেশের বসন্ত। তখনো মাঝে-মাঝে উত্তর আর দক্ষিনের বায়ূ লড়াই করে বেরসিকের মতো! আগের দিন তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রী তো পরদিন ৭০ ডিগ্রী। আমাদের দেশে মিডিয়াগুলো যেমন রাজনৈতিক উত্তেজনার খবর ছড়াতে ভালবাসে, আমেরিকার মিডিয়াগুলোও তেমনি "ওয়েদারের" উত্তেজনায় বেশ মজা পায়। তাইতো হারিক্যান আইরিনকে নিয়ে এতো মাতামাতি। সিএনএনতো এক হ্যারিকেন ছাড়া আর কোন সংবাদই আমলে নিচ্ছে না? একেই হয়তো বলে মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদ।
আমি সংবাদপত্রে কাজ করার আগে ভাবতাম শীর্ষ সংবাদটি না জানি কতো গুরুত্বপূর্ণ! এরপর কাজ করার সময় যখন দেখলাম আমার মতো 'ডাম এন্ড ডাফ' একটি লোক প্রতিদিন লীড স্টোরি বাই-লাইনে লিখে কেবল সম্পাদকের অনুগ্রহে- এরপর দিনে দিনে মিডিয়ার ওপর থেকে আমার শ্রদ্ধা নেমে যেতে থাকে পারদের মতো। সে ১৯৯১ সালের কথা, আজকার কাগজ যখন হই-হই-রই-রই করে বাজারে আসে। দুর্ভাগ্য কাগজটি এখন বন্ধ! আজ সিএনএন-এর এই দশা দেখে আমার একই করুণা হলো। হ্যারিকেন আইরিন, এখন বুশ আমলের হ্যারিকেন ক্যাটরিনার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঠেকাতে কে বেশি পারদর্শী- বুশ না ওবামা? এর উপর নিভর করছে আমেরিকার ২০১২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। অবশ্য একই সঙ্গে বহির্বিশ্বে আমেরিকার ভাবমূর্তির বিষয়টিও জড়িত।
লিখতে বসে আমার মনে হচ্ছে ঘূর্ণিঝড়- জলোচ্ছ্বাসের সংবাদ বাংলাদেশের মানুষের কাছে মামুবাড়ির গল্পের মতো। হ্যারিকেন আইরিন উৎপত্তি হয়েছে বাহামার কাছাকাছি। দক্ষিন ও উত্তর ক্যারোলিনায় আঘাত হেনেছে, ওয়াশিংটন হয়ে ধেয়ে আসছে দেলাওয়ার ও নিউইয়র্কের দিকে। এরপর কানাডার উপকুল ঘেঁসে আবার মিশে যাবে আটলান্টিকে। আজ শনিবার দুপুর থেকেই নিউইয়র্কের গণ পরিবহন বন্ধ। বাতাসের ঝাঁপটা শুরু হবে বিকেল থেকে। মানুষের মৃত্যু আশংকা কম। কারন উপকূলের সবাই নিরাপদে সরে গেছে। আর সাড়ে ছয় হাজার মেরিন সেনা সদা প্রস্তুর রয়েছে হ্যারিকেন মোকাবেলায়।
মানুষের সবচেয়ে বেশি আশংকা- হ্যারিকেনের কারনে বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটতে পারে স্থান ভেদে কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত। এ কারনে বাজার থেকে, পানি, মোমবাতিসহ মুদি সদাই করছে মানুষজন। গ্যসোলিন কিনে রাখছে। কিনছে সিএনএন যে আতংক তৈরি করেছে, তা কাজ করেছে বলে মনে হয়।
***
নিউইয়র্ক, ২৭ জুলাই, ২০১১