কেমন আছেন তারেক জিয়া?

জহিরুল চৌধুরী
Published : 14 Sept 2011, 02:24 PM
Updated : 14 Sept 2011, 02:24 PM

বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ভাবতে, কথা বলতে কিংবা লিখতে অনেকেরই রুচিতে বাধে। আমিও সে দলের একজন। কিন্তু কি করবেন, আমাদের যে ঘুরে ফিরে রাজনীতির কাছে আসতেই হয়। মন্দ রাজনীতি যেমন আমাদের জীবনকে দূর্বিসহ করে তুলে, তেমনি ভাল রাজনীতিও পারে আমাদের জীবন প্রবাহকে ঘুরিয়ে দিতে। ছোটকালে নয়, বড়কালে 'ছোটদের রাজনীতি' নামক বইটিতে যেমন পড়েছিলাম- ঘুম থেকে উঠে দাঁত-মাজন হাতে নিলেই যেমন রাজনীতি শুরু হয়, তেমনি আপনি পৃথিবীর যেখানেই থাকুন রাজনীতি আপনাকে ছাড়বে না। ইটের নীচে মরে যাওয়া হলদে ঘাসে আঁচড় কেটে যেমন একজন গোয়েন্দা দীর্ঘদিনের পুরনো হত্যা রহস্য উদঘাটন করতে পারেন, তেমনি একজন পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ পারেন নিজের হলদে বর্তমানকে সবুজ সতেজে পরিপূর্ণ করতে।

বাংলাদেশের মুকুটহীন যুবরাজ তারেক রহমান বিএনপির যুগ্ন মহাসচিব। একজন জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট বাবা, এবং একজন প্রধানমন্ত্রী মায়ের প্রথম সন্তান। বিশ্বের সমসাময়িক রাজনীতির ইতিহাসে এত বড় পিতৃ-মাতৃ পরিচিতি আর কোন রাজনীতিকের আছে বলে আমার জানা নেই। অথচ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস আজ একপ্রকার নির্বাসনে, পরবাসে দিন কাটছে আপনার। কোন মুচলেকায় আপনি দেশের বাইরে, বাংলাদেশের মানুষের তা জানার অধিকার আছে। তথাপি দেশের মানুষ আপনাকে রাজনীতিতে পুণর্বাসিত হতে দিতে চায় কি-না, সে প্রশ্ন করার আগে বর্তমান সরকার এবং আপনার খালা-আম্মা শেখ হাসিনা যে আপনাকে পুণর্বাসনের সব পথ করে দিচ্ছেন তাতে আমার বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই। হয়তো সেদিন বেশি দূরে নয়, বিমানবন্দরে লাখো জনতার কাঁধে ভর করে আপনি দেশে ফিরবেন। ফুলে-ফুলে ভরে যাবে পুরো বিমানবন্দর সড়ক, আকাশে পাখা মেলবে শান্তির কপোত, বাতাসে শোনা যাবে মহালয়ার আগমন ধ্বনি!

কিন্তু এই অভাজনকে যদি প্রশ্ন করেন- তাহলে বলবো এমন আলামত দেখার আগেই আমি বিপরীত দিকে পালাবার পথ খুঁজবো। কারন আমি আর ওয়ান-ইলিভেন পূর্ববর্তী অরাজকতায় ফিরে যেতে চাই না। আমার সন্তানের ভবিষ্যতকে আমি আর অমন অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে চাই না। আপনি হয়তো বলবেন- কেন আমি আবার কি করলাম? এ প্রশ্নটি করার আগে আরো কিছু প্রশ্ন আপনার নিজেকে করতে হবে, সে সময় ও সুযোগ বর্তমানে আপনার আছে। ২০০৬ পূর্বাপর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য আপনি দায়ি, এমন মূর্খ মন্তব্য আমি কখনো করবো না। কিন্তু পরিস্থিতি যেভাবে খারাপের দিকে ধাবিত হয়েছিল, তার লাগাম ধরে রাখার সব কলকাঠি ছিল আপনারই হাতে। বনানীর হাওয়া ভবন থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি, প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা আর অপরাধ সাম্রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণের এক অদ্ভূদ কলাকৌশল আপনি উদ্ভাবন করেছিলেন, এটা আপনার একক কৃতিত্ব। এতে করে সংসদ, সচিবালয়, হাইকোর্ট, নির্বাচন কমিশন- রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অর্গানগুলো বিকলাঙ্গ এবং ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। সর্বশেষ রাষ্ট্রের মর্যাদা, নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার প্রতীক বঙ্গ ভবনকেও আপনি অথর্ব করে তুলেছিলেন আপনার চেলা চামুণ্ডাকে ওই ভবনে চাকুরিতে বসিয়ে। রাষ্ট্রটিকে ঠুটো জগন্নাথ বানিয়ে লাভ হলো কী? সেনাবাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় জরুরী অবস্থা। আর এ ধরনের জরুরি অবস্থা আপনার মতো রাজনীতিবিদদের জন্য যত না যন্ত্রণাকর, তার চেয়ে শত গুণ বেশি যন্ত্রণাদায়ক সাধারন মানুষের জন্য। আপনি হয়তো মুখ টিপে হাসছেন। কিন্তু আপনার কাজটি হয়েছিল খুবই বাল-সুলভ। শুনেছি হাওয়া ভবনে ছাত্রদলের বালকরাই ছিল আপনার প্রধান পরামর্শক। এরা কর্মঠ এবং উদ্ভাবক সন্দেহ নেই, কিন্তু এরা অভিজ্ঞ নয়। সুতরাং ভবিষ্যতে এদের হাতে নিজের অভিভাবকত্ব সপে দেয়ার আগে কিংবা আপনি নিজে এদের অভিভাবকত্ব গ্রহণের আগে নিজেকে আবারো প্রশ্ন করবেন এ আমার প্রত্যাশা।

আপনার মধ্যে বালক সুলভ চপলতা এখনো বর্তমান, কিন্তু এটা দোষের কিছু নয় যদি আপনি স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করেন। আপনি না পারছেন মাম্মির আঁচল ছাড়তে, না পারছেন মাম্মির কাছ থেকে কিংবা মাম্মির দোষ-গুণ থেকে শিক্ষা নিয়ে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে। এই দোটানায় আপনার অস্থির চিত্তকে প্রশমন করতে আপনি বন্ধু বিহারে গাজীপুরের বাগান বাড়িতে যেতেন, রাত কাটাতেন। তা আমাদের দেশের নর্মস এবং ভ্যালুজে তা মানান সই নয়। এ কারনে বহু রাজনীতিক বেছে নেন ব্যাংকক-সিঙ্গাপুরের অবকাশ যাপন। আপনিও তা করতে পারতেন। এতে করে আপনার স্নায়ু দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে যে সব বন্ধু-বান্ধব অন্যায় আব্দার করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হতে চেয়েছে, আপনি তাদের 'না' বলতে পারেননি। ইত্তেফাকে রিপোর্ট প্রকাশের পর ২০০৭ সালে আমি ঐ বাড়িটি দেখতে যাই সরেজমিনে। উঁচু পাচিলের দূর্গ-সদৃশ বাড়িটি দেখে আমার কেবল আফসোস হয়েছে, আমি আল্লাহকে বলেছি- হায় আল্লাহ তুমি যারে দাও, তারে কেন হাত ভরে দাও!

রাজনীতি এবং ব্যবসা পৃথিবীর সর্বত্র সৃষ্টি করে ক্লেশ এবং ক্লেদ। দেখুন না আমেরিকায় সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসা করতে যেয়ে নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যতকে কীভাবে একেবারে পঙ্গু করে দিল! আপনি রাজনীতি করতে চাইলে ব্যবসা বাদ দিতে হবে। কারন ব্যবসার সর্বকালীন প্রবণতা থাকে রাষ্ট্রকে ফাঁকি দেবার। এমন কি কোকো'কেও বলতে হবে- এসব কমিশন ভোজী ফটকা ব্যবসার বদলে দেশের শিল্পায়নে যথাসাধ্য ভূমিকা রাখা। প্রয়োজনে চায়নার গুয়াংজু থেকে সেদেশের শ্রমঘন শিল্পগুলোকে বাংলাদেশে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেয়া। সবকিছু সবার জন্য মানায় না। জিয়ার সন্তানরা বেঁচে থাকার জন্য ফটকাবাজি করুক, মানুষ তা ঘেন্না করে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তি ক্ষণভঙ্গুর পরিস্থিতি সামলে জিয়া দেশকে এগোনোর চেষ্টা করেছিলেন, মানুষ তা জানে ও বিশ্বাস করে। কাজেই তার সন্তানরা লালু-ফালুর মতো সম্পদ আহরনে ভাগাড়ে ডুব মারবে তা কি করে হয়?

ভালো শাসক হওয়ার জন্য যেমন সার্টিফিকেট, ডিগ্রী আর বিশাল গণ মিছিল অপ্রযোজনীয়, তেমনি অপ্রয়োজনীয় তোষামোদকারীও। পরাধীন যুগে রাজনীতিবিদরা জেলে যেতেন আত্মোপলব্দির জন্য। পড়াশুনা করতে-করতে বই লিখতেও শুরু করতেন। রাজনীতির জন্য বই পড়ার বিকল্প নেই। আপনি তো জানেন লাইব্রেরী অব কংগ্রেস বিশ্বের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি, সৃষ্টি হয়েছিল রাজনীতিবিদদের জন্যেই। এখন অন লাইনেও সারাবিশ্বের মানুষ এ লাইব্রেরিতে ঢুঁ মারতে পারেন। আমেরিকায় প্রতিটি প্রেসিডেন্টের বাড়ির বিশাল লাইব্রেরি সাধারন মানুষের জন্য উন্মুক্ত। এসব লাইব্রেরি ঢাকার পাবলিক লাইব্রেরির চেয়েও বড়। আপনি একটু সচেতন থাকলে ৬ মঈনুল রোডের বাড়িটিও হতে পারতো প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরি। তাতে আপনার নাম লিখা থাকতো ইতিহাসের পাতায়। আজ ইতিহাসের পাতায় আপনার নাম লিখা আছে ঠিকই তবে তা নিজের আখের গোছানো, আর ভুঁইফোঁড়দের আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বানানোর জন্য।

শেষ কথা বলার আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে দুটো কথা বলে রাখি। ১৯৯০ সালে সামরিক স্বৈরশাসন বিদেয় নেয়ার পর বাংলাদেশে একদলীয় স্বৈরশাসন চলছে। এর একটি মাত্র কারন- জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। পরিকল্পিতভাবে এরা জাতীয় সংসদকে অকার্যকর করে রেখেছেন। এ ক্ষেত্রে সরকারি এবং বিরোধী দল উভয়কে ছাড় দিতে হবে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক করার প্রয়োজনে। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক না হলে মাঝে-মাঝেই স্বৈরতন্ত্র জেঁকে বসতে পারে। রাজনীতি কেবল রাস্তায় মিটিং-মিছিল, কিংবা জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল নয়। রাজনীতির প্রথম কথা- নিজের দেশ এবং দেশের মানুষকে জানা, তাদের অধিকার এবং সমস্যাগুলোর সঙ্গে পরিচিত হওয়া। এ কারনেই পার্লামেন্ট, কিংবা জাতীয় সংসদ নামক 'পাঠশালা'র উৎপত্তি।

স্কুলে না গিয়ে যেমন ভালো ছাত্র হওয়া যায় না, তেমনি জাতীয় সংসদে উপস্থিত না থেকেও ভালো রাজনীতিক হওয়া যায় না। গণতন্ত্র চর্চায় আমরা এখনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সে কারনে আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উদাহরণই দেবো। যেমন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সামনের আসনে কে বসবে, এ নিয়ে কোলাহল এবং 'কাইজ্জা'র অভিজ্ঞতা আমাদের সবার আছে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষক 'কাইজ্জা'র সমাধান করে দেন- মেধাবী এবং নিয়মিত ছাত্রটিকে সামনের আসনে জায়গা করে দিয়ে। রাজনীতির ক্ষেত্রে শিক্ষক হলো জনগন। তারাই ঠিক করে দেবে পরবর্তী মেয়াদে কে বসবে সামনের আসনে। সে কারনে সংসদে আপন যোগ্যতা-মেধার পরিচয় দেবার সুযোগ রয়েছে সংসদ সদস্যদের। আজ বিএনপি'তে যে নেতৃত্বশূন্যতা, তা দূর হতে পারতো সংসদে নিয়মিত উপস্থিতির মাধ্যমে।

ক্ষমতা এবং অর্থ থাকলে মানুষ অনেক ভালো কাজ করতে পারে। আপনি সেসব কাজের একটি ছক এখনি তেরি করবেন, সে প্রত্যাশা আমার। আমার অল্পদামের পরিশ্রমী বাবা আমাকে সবসময় ছড়াকেটে একটি কথা বলতেন- 'যোগ্য যার ভাগ্য তার কিছু তে না টুটে, ডুবিলেও তরী তার পুণঃ ভাসি উঠে'। হতাশা আমাকে গ্রাস করতে পারে না, যখনি আমি এ চরণটি আওড়াই। ঝড়-ঝঞ্জার পূর্বাভাস জেনেই মাঝি নদীতে নাও ভাসায়। সে কারনে তরী ডুবলে, মাঝিকেই নিতে হয় সব দায়দায়িত্ব। এটি যেমন টাইটানিকের ক্ষেত্রে সত্যি, তেমনি সত্যি ডিঙ্গি নৌকার ক্ষেত্রেও। আশা করি আমাদের চারপাশের বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আপনি ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সাজাবেন।

***
লেখাটি অন্য একটি ব্লগে প্রকাশিত, এবং পরিমার্জিত।
১৭ই জানুয়ারি ২০১১, নিউইয়র্ক