জিয়ার পর জিয়া: শেষ কোথায়?

বিজন সরকার
Published : 10 August 2016, 06:28 AM
Updated : 10 August 2016, 06:28 AM

ধর্মীয় উগ্রবাদ কি বিচ্ছিন্নভাবে হঠাৎ করেই আমাদের সমাজে চেপে বসল? নাকি আমাদের রাজনীতির প্রাণকোষে উগ্রবাদবান্ধব ও জঙ্গি আদর্শিক উপাদানের বাই-প্রডাক্ট এটি? কিংবা বাংলাদেশের জন্মকে যারা এখনও রাজনৈতিকভাবে বিশ্বাস করে না– রাজনীতি নানা ছলনায় সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্য করে তোলার যে প্রক্রিয়া; উগ্রবাদের বিষক্রিয়ায় কি সেই রাজনীতির কোনো দায় নেই?

প্রশ্নগুলির উত্তর দুটি বড় রাজনৈতিক শিবিরের আদর্শের মধ্যেই নিহিত। অধিকন্তু, প্রশ্নগুলির মূল উত্তর সত্তরের নির্বাচনের ফলেই প্রকাশিত।

সত্তরের নির্বাচনের মূল ইস্যু ছিল বাংলাদেশের জন্মের প্রশ্নটি। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ২৮ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছিল; মানে এই ২৮ শতাংশ ভোট বাংলাদেশের জন্মের বিপক্ষে ছিল।

ফলে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য রাজনীতিকে বুঝতে হলে বাংলাদেশ জন্মবিরোধী ২৮ শতাংশ ভোটের দর্শনকে বুঝতে হবে। এই প্যারামিটারকে বাইরে রেখে বাংলাদেশের বিদ্যমান বিভাজিত রাজনীতির মৌলিক দর্শনের মূল্যায়ন করা ভুল হবে।

স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলাম ও নেজামে ইসলামের মতো ধর্মীয় দলগুলি নিষিদ্ধ ছিল। তবু স্বাধীনতার পরপরই সমাজে তাদের আদর্শিক প্রতিনিধিত্ব দেশের রাজনৈতিক দর্শনচর্চার ক্ষেত্রে ভূমিকা ঠিকই রেখেছিল। দলগুলি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগবিরোধী জাসদকে সহযোগিতা করেছিল।

সত্তরের নির্বাচনের ২৮ শতাংশ ভোটের আদর্শিক অবস্থান থেকে মুক্তি পায়নি। পরিষ্কারভাবে বললে, এই ২৮ শতাংশে যেমন বাংলাদেশের জন্মবিরোধী ভোট ছিল, তেমনি ছিল আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিরোধী। আওয়ামী লীগবিরোধীরা কেবল আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়েই বাংলাদেশের জন্মের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সেই ২৮ শতাংশ ভোটের বড় বিজয় হয়। পঁচাত্তরের পটভূমি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শেক্সপিয়ারের চরিত্র ম্যাকবেথের একটি জেরক্স বা ফটোকপি বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবির্ভাব ঘটে। সেই জেরক্সকপির নাম মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।

বিএনপির রাজনৈতিক শিবির থেকে বলা হয়ে থাকে, পঁচাত্তরের ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগই দায়ী। নির্মোহ সত্য যে আওয়ামী লীগের একটি অংশ পঁচাত্তরের চক্রান্তের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু ঘটনাটি ঘটিয়েছিল সেনাবাহিনীর একটি অংশ, যারা মেজর জিয়াউর রহমানকে সম্ভাব্য ক্যু সম্পর্কে জানিয়েছিল।

পঁচাত্তরের ঘটনার রাজনৈতিক বেনিফেশিয়ারি ছিলেন জিয়াউর রহমান। অনেকেই এটিকে সমাপতন বলে চালিয়ে দিতে চান। বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জিয়াউর রহমানের ক্ষমতাগ্রহণ যে সমাপতন ছিল না তা জিয়াউর রহমানের প্রত্যেকটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে স্পষ্ট। উদাহরণ: ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচার না করে বরং বিচার চাওয়ার স্বাধীনতাকেই কালো আইন করে করব দেওয়া হয়। হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করেন জিয়াউর রহমান।

মেজর জিয়াউর রহমান তৎকালীন রাজনৈতিক অস্থিতিশীল অবস্থাকে ভালোভাবেই মূল্যায়ন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দিলে রাজনৈতিক নেতৃত্বে এমন ব্যক্তিত্ব নেই যিনি দেশকে পরিচালনা করতে পারবেন। জিয়াউর রহমান তা বুঝতে পেরেছিলেন। ফলে কর্নেল রশিদদের প্রস্তাবে তিনি বাধা দেননি।

সেনাবাহিনী ক্ষমতা গেলে জাতীয় ও বৈশ্বিক রাজনীতির বিবেচনায় পাকিস্তানপন্থী সেনাদের হাতে যে ক্ষমতা থাকবে– সেটিও জিয়াউর রহমানের মূল্যায়নে ছিল।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট-উত্তর প্রেক্ষাপটে, বিশেষ করে ৭ নভেম্বরের ঘটনার পর জিয়াউর রহমানের সামনে আর কোনো বাধাই থাকল না। ম্যাকবেথে যে তিনজন জাদুকরী জেনারেল ম্যাকবেথকে প্রলোভন দেখিয়ে ক্ষমতার জন্য মরিয়া করে তুলেছিল, অনুরূপভাবে জিয়াউর রহমানকেও তিনটি জাদুকরী শক্তি ক্ষমতায় জন্য মরিয়া করে তোলে।

সেই তিন জাদুকরী শক্তির প্রথমটি ছিল দেশীয় অপশক্তি। এ দলে আছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, মৌলবাদ, প্রথাগত আওয়ামী লীগ-বিরোধীরা এবং সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনে পাকিস্তানপন্থী ও পাকিস্তান-ফেরত আমলারা, যাঁরা প্রথম জাদুকরীর ভূমিকা পালন করেন। জিয়াউর রহমানের সময়ে জাতীয় রাজনীতিতে ও বৈশ্বিক পুঁজিবাদ সম্প্রসারণে মৌলবাদ ছিল উগ্রবাদ রাজনৈতিক আদর্শের বড় সম্পদ।

দেশের স্বাধীনতাবিরোধীরা ক্ষিপ্র বাঘের মতো তাদের বিকল্প রাজনীতি খুঁজছিল। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় ইসলামিক দলগুলি রাজনীতি করার সুযোগ পাচ্ছিল না। জামায়াতে ইসলাম ও নেজামে ইসলামের মতো দলগুলি যদি স্বাধীনতার বিরোধিতা না করত, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বিএনপির রাজনীতির জন্মই হতো না বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।

জামায়াতে ইসলাম যদি স্বাধীনতাবিরোধী না হতো কিংবা স্বাধীনতার পরপরই যদি রাজনীতি করার সুযোগ না হারাত, পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থনেই জামায়েত ইসলাম বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় দল হিসাবেই থাকত। আওয়ামী লীগের বিপক্ষে বিএনপিকে কৃত্রিমভাবে জন্ম দেওয়ার প্রয়োজন হতো না।

সেই সময় আওয়ামী লীগবিরোধী যে কোনো সংগঠিত শক্তি স্বাধীনতাবিরোধী ও উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর সমর্থন পাবে, জিয়াউর রহমান ভালো করেই তা অনুধাবন করেন। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগবিরোধী জাসদ ও বাম রাজনীতির সমর্থন ছিল বাড়তি পাওনা। ফলে দেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামের রাজনীতির যে কোনো প্রতিস্থাপন যে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাজারে ভালোই চলবে– এটিও জিয়াউর রহমান দূরদর্শন করেছিলেন।

দ্বিতীয় জাদুকরী শক্তি ছিল পাকিস্তানের সেনা গোয়েন্দা সংস্থা। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পরপর কার্যত বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা পাকিস্তানের আইএসআইয়ের হাতে চলে যায়। একাত্তরে বাংলাদেশের জন্মের সময় ভারতের ভূমিকা ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক সখ্য আইএসআইয়ের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সম্পর্ককে বিশ্বস্ত ও বন্ধুত্বপূর্ণ করতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দেশের শাসনক্ষমতা যে জিয়াউর রহমানের কাছেই থাকছে– পাকিস্তানের নীতি নির্ধারকেরা সেই অভয় শেক্সপেরিয়ান চরিত্রের অধিকারী জিয়াউর রহমানকে দিয়েছিলেন।

তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক 'ঠাণ্ডা যুদ্ধ' জিয়াউর রহমানের ক্ষমতালিপ্সার প্রতি তৃতীয় জাদুকরী শক্তি হিসাবে ভূমিকা রাখে। সমাজতন্ত্র হঠানোর প্রকল্পে পশ্চিমা বিশ্ব এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় উগ্রবাদকে সমর্থন দিয়েছে। যেখানে ধর্মীয় উগ্রবাদ সমাজের ততটা গভীরে যায়নি, সেখানে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতায় এনে ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়।

জিয়াউর রহমান সেই সময়ের পশ্চিমা সামরিক শাসক প্রকল্পের বাই-প্রডাক্ট। ফলে জিয়াউর রহমান সামরিক শাসক প্রকল্প পরিচালকদের কাছ থেকে ক্ষমতায় থাকার ম্যাকবেথকে জাদুকরীদের দেওয়া ভবিষ্যদ্বাণীর মতোই আশ্বাস পেয়েছিলেন।

জিয়াউর রহমানের পাকিস্তানি মডেলের সামরিক রাজনীতি বাংলাদেশের ভেতরকার সুপ্ত উগ্রবাদকে জাগিয়ে তোলে। আজকের জঙ্গিবাদের সূচনা হয় তাঁর সময়েই। আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণার জন্য তাঁর সময়েই 'আমরা ঢাকাবাসী' ও 'নবিয়ুতে আন্দোলন' (এটি পাকিস্তানের একটি সংগঠন) নামে দুটি ধর্মীয় গোষ্ঠী সরকারের সমর্থনে ঢাকায় জঙ্গি মিছিল করে। সরকারের উদ্দেশ্য ছিল দেশের উগ্রগোষ্ঠীকে একটি বার্তা দেওয়া যে সরকার উগ্রবাদবান্ধব।

সেনাবাহিনীতে শত শত মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের ক্যাঙারু সামরিক কোর্টের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। জিয়াউর রহমানের সময়ের দলীয় রাজনীতিমুক্ত একজন সেনা অফিসারের একটি সাক্ষাৎকার দেখেছিলাম। এখনও হয়তো ইউটিউবে পাওয়া যাবে সেটি। ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের সেই সময়ের ঘটনা বর্ণনায় তিনি বলেছিলেন, এমনও ঘটেছে যে জেলবন্দি সেনাদের কেউ ভোরে নামাজ পড়ার জন্য যাচ্ছেন, তাদের অনেককেই রাস্তা থেকে ধরে সরাসরি ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। অনেকেই হাউমাউ করে কেঁদেছেন। কোনো লাভ হয়নি। ফাঁসিতে ঝুলতেই হয়েছে। অনেকেই মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে জানতে পারতেন যে তাঁর ফাঁসি হবে।

জিয়াউর রহমান দেশের প্রগতিশীল রাজনীতির প্রতিটি স্তরে উগ্রবাদ নামের 'ভাইরাস'-এর সংক্রমণ ঘটান। যে ভয়ঙ্কর উগ্রবাদের কথা চিন্তা করে আমরা জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত, সেটির বীজ বপন জিয়াউর রহমানই করেছিলেন। তাঁর প্রতিটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আসত আইএসআইয়ের প্রেসক্রিপশন থেকে।

যদি তা-ই না হবে, গোলাম আজমকে কেন পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আনা হল? বাংলাদেশের জনগণ কি মেজর জিয়াউর রহমানকে হাতেপায়ে ধরে কান্নাকাটি করে বলেছিল, "মাননীয় সামরিক শাসক, আমরা একাত্তরের ঘাতক গোলাম আজমকে বীরের মর্যাদা দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনতে চাই।"

পাকিস্তানি পাসপোর্ট থাকা সত্ত্বেও কেন গোলাম আজমকে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছিলেন? আমরা কি কোনো পাকিস্তানিকে বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ দিতে পারি? সামান্যতম একাত্তরের চেতনা ধারণ করলে প্রশ্নটির উত্তর হবে 'না'। জিয়াউর রহমান যদি পাকিস্তানপন্থী না-ই হবেন শাহ আজিজুরের মতো একজন কুখ্যাত রাজাকারকে কেন প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন?

কোনো সন্দেহ নেই জিয়াউর রহমান একটি ঐতিহাসিক চরিত্র। শেক্সপিয়ার যদি আজ বেঁচে থাকতেন, এমন আধুনিক খলনায়ক চরিত্র দেখে নিজের নাটকে নির্মিত খলনায়ক চরিত্র নির্মাণের সার্থকতা খুঁজে পেতেন! নিজের ক্ষমতাকে স্থায়ী করতে সামনে সামান্যতম প্রতিবন্ধকতাও জিয়াউর রহমান রাখেনি। নিজের জীবন রক্ষাকারী ও বন্ধু কর্নেল তাহেরকেও ঠাণ্ডা মাথায় খুন করাতে দ্বিধা করেননি তিনি।

অথচ কর্নেল তাহের ছিল একমাত্র পঙ্গু সেক্টর কমান্ডার। 'জেনেভা কনভেনশন' অনুযায়ী কোনো পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসি দেওয়া যায় না। জিয়াউর রহমান এতটাই মরিয়া ছিলেন যে কোনো আইনকানুনের তোয়াক্কা করেননি। তবু তাঁর শেষ রক্ষা হয়নি। একজন সেনাশাসক যখন ক্ষমতার সিঁড়িতে ওঠেন নিচের প্রতিটি ধাপ ভেঙে ওঠেন। ফলে নামার আর কোনো উপায় থাকে না।

ফলে বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থী রাজনীতি, ধর্মীয় উগ্রবাদের প্রসার, রাজাকার পুনর্বাসন ও জঙ্গিবাদের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন প্রদানের ইতিহাস মেজর জিয়াউর রহমানের রাজনীতিকে মূলভিত্তি ধরে ভাবাই আবশ্যক। জিয়াউর রহমানের কারণেই ধর্মীয় রাজনীতির নানা কুপ্রভাব সমাজকে ডানপন্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। জামায়াতে ইসলাম যদি স্বাধীনতার বিরোধিতা না করত স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির জন্মের প্রয়োজন হতো না। ঠিক একইভাবে জিয়াউর রহমান যদি ধর্মীয় রাজনীতি চালু না করতেন আজকের বাংলাদেশকে ধর্মীয় উগ্রবাদ নিয়ে সমস্যায় পড়তে হতো না।

আজ জিয়াউর রহমান নেই। তবে কথিত জাতীয়তাবাদের মোড়কে তাঁর উগ্রবাদ আদর্শের জাল আগের চেয়ে বেশি বিস্তৃত। সত্তরের সেই ২৮ শতাংশ ভোটারদের দর্শন এখনও বাস্তব। এখনও সেই দর্শনের ওপর নির্ভর করেই সামরিক ক্যুর স্বপ্ন দেখা হয়, উগ্রবাদীরা বাংলাদেশকে 'বাংলাস্তান' বানাতে চায়।

২০১১ সালের ডিসেম্বরে শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে একটি সামরিক ক্যুর চেষ্টা করা হয়। সেনাবাহিনীতে তৎকালীন সময়ে কর্মরত ও সাবেক কিছু কর্মকর্তা এই চক্রান্তে জড়িত ছিলেন। এর পরিকল্পনাকারী ছিলেন সেনাবাহিনীতে কর্মরত মেজর জিয়াউল হক। এই ঘটনায় অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল এহসান ইউসুফ ছাড়াও অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাকিরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে মূল পরিকল্পনাকারী মেজর জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই পালিয়ে যান।

মেজর জিয়া অন্য অফিসারদের এই চক্রান্তে লিপ্ত করার জন্য আলোচনা শুরুর সময়ই তা প্রকাশ পায়। মেজর জিয়া হিজবুত তাহরিরের শীর্ষ স্তরের নেতা। পালিয়ে থাকা মেজর জিয়া ই-মেইলে 'মধ্যম সারির অফিসারেরা খুব শিগগিরই বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে'– এমন একটি বার্তা ছড়িয়ে দেন। পরবর্তীতে জামায়াতের মুখপত্র (পত্রিকা) ও নিষিদ্ধঘোষিত ধর্মান্ধ হিযবুত তাহরির মেজর জিয়ার বার্তাটিকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়।

পালিয়ে থাকা মেজর জিয়া কেবল অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে নয়, সেনাবাহিনীতে কর্মরত কতিপয় সেনা অফিসারদের সঙ্গেও ক্যুর বিষয়ে আলোচনা করেন এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করেন। সম্ভাব্য ক্যুর প্রস্তুতি সম্পর্কে তিনি সেনাবাহিনীতে তাঁর সমমনা অফিসারদের সঙ্গে পরামর্শ করেন এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তাগিদ দেন। সম্ভাব্য ক্যুর তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০১১ সালের ১০ জানুয়ারি।

১০ তারিখেই মেজর জিয়া হংকংয়ে প্রবাসী ইশরাক আহমেদের সঙ্গে কয়েকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেন। ক্যুর খবর দেশে বিদেশি গণমাধ্যমে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় ইশরাককে।

ফলে মেজর জিয়ার নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি যে বহুদূর পর্যন্ত চলে গিয়েছিল তা স্পষ্ট। মেজর জিয়া ক্যুর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। বাস্তবায়ন হলে হয়তো মেজর জিয়া বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মেজর জিয়ার মতোই দেশের ধর্মীয় দলগুলির সঙ্গে মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকতেন। বাকস্বাধীনতা সংকুচিত হতো, ধর্মের প্রয়োজনীয়তার ছবক জাতীয় গণমাধ্যমে শোনা যেত, হাটহাজারি ও মগবাজারের ব্যস্ততা বেড়ে যেত। দেশের ভেতর কথিত নাস্তিক ও বিপন্ন হয়ে যাওয়া প্রকৃত সুশীলদের লাশ রাস্তার পাশে পড়ে থাকত!

'নষ্ট' বামেরা মেজর জিয়ার সামরিক শাসনে 'ফ্রিডম' ও 'পিস' খুঁজত। ভারতবিরোধী রাজনীতি আবার কার্পেটের নিচ থেকে তুলে আনা হতো। গুলশানে পশ্চিমা কূটনৈতিকরা নানা ফর্মুলা নিয়ে সকালবিকাল বয়ান দিতেন। পাকিস্তানবিরোধীদের ওপর চলত নির্যাতনের বুলডোজার।

মেজর জিয়ার সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়ার বাংলাদেশ আরেকটি পাকিস্তানপন্থী ব্রেক-থ্রু থেকে রক্ষা পেল। আদর্শিকভাবে এই পলাতক মেজর জিয়া বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মেজর জিয়ার 'টুইন' হতেন। তবে পরিকল্পনা নস্যাৎ হওয়ার পরও মেজর জিয়া থেমে থাকেননি। গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুয়ায়ী সেভেন-ওয়ানে গুলশান ও ঈদের দিন শোলাকিয়ার জঙ্গি হামলার নেপথ্যের নায়ক এই মেজর জিয়া। তাঁর সঙ্গে রয়েছে কানাডিয়ান প্রবাসী বাঙালি তামিম চৌধুরী।

এমতাবস্থায় জিয়াদের হাত থেকে বাংলাদেশের মুক্তি দরকার। বাংলাদেশ আর পিছনে হাঁটতে রাজি নয়। পাকিস্তানি মডেলের রাজনীতি ও সমাজ নির্মাণ করে প্রতি সকালে গ্রেনেডের শব্দে ঘুম থেকে উঠতে প্রস্তুত নয় বাংলাদেশ। প্রতি জুমাবারে মসজিদে জায়নামাজকে রক্তে লাল করতে ইচ্ছুক হয় বাংলাদেশ।

তবু জিয়ার পর জিয়ার আগমন ঘটছে। এর শেষ কোথায়?