যে নাঈম ভাইকে আমি জানতাম

জহিরুল চৌধুরী
Published : 28 Sept 2011, 03:55 PM
Updated : 28 Sept 2011, 03:55 PM

১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের সকাল। পুরানা পল্টনে সিপিবি অফিসের পাশে চায়ের দোকানে এক অনির্ধারিত আড্ডা। আমি তখন প্রায় বেকার। চট্টগ্রামের পাট চুকিয়ে ঢাকায় নরম মাটি খুঁজে বেড়াচ্ছি। কোথাও শেকড় পোতা যায় কি না! ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা পতনের পর আমার মতো অনেক তরুন-যুবা'র হাতে অফুরন্ত সময়। সকাল থেকে এখানে-ওখানে চাকরির ধান্ধা, বিকেলে পার্টি অফিসে খই ভাজা, আর সন্ধার পর আবু'দের কম্পিউটার ট্রাইনিং সেন্টারে লোটাস ১২৩-র হাতেখড়ি নেয়া- এই আমার রুটিন। কোন-কোন দিন রামপুরা থেকে বাসে উঠে ১ টাকায় চলে যেতাম সর্বশেষ গন্তব্যে। সদরঘাটে নেমে হারিয়ে যেতাম জন অরন্যে। মুনতাসির মামুনের ঢাকার স্মৃতি কথা পড়তাম, আর খুঁজে বেড়াতাম আহসান মঞ্জিল, লাল বাগের কেল্লা, পরী বিবির মাজার, চক বাজার, ঢাকেশ্বরী মন্দির কিংবা আরমেনীয় চার্চ। তখন থেকে পুরনো ঢাকা, আমি বলি 'বনেদি ঢাকা', আমার খুব প্রিয়। এখানে প্রাণ আছে, আছে প্রাচুর্য্যও। যাই হউক, বলছিলাম- সকাল বেলাকার অসময়ের আড্ডার কথা। ঢাকা ছাত্র ইউনিয়নের নেতা লিটন ভাইকে বললাম, আমার যে একটা স্থায়ী চাকরির ভীষণ প্রয়োজন। তখন পার্ট টাইম, মানে সপ্তাহে এক-দুই দিন ইংরেজী থেকে বাংলা অনুবাদের কাজ করি একটি এনজিও ম্যাগাজিনে। লিটন ভাই বলল- খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখলাম, শিগগির আজকের কাগজ নামে একটি দৈনিক বেরুবে। আপনি ওখানে যোগাযোগ করুন। তখন 'খবরের কাগজ' নামে একটি সাপ্তাহিক প্রকাশিত হতো নাঈম ভাইয়ের নেতৃত্বে। ভিন্নমাত্রার এ সাপ্তাহিকিটি তখন বেশ জনপ্রিয় ছিল এর উদার এবং নিরপেক্ষ বৈশিস্টের কারনে। এটি বের হতো কাজী শাহেদ আহমেদের ঠিকাদারি অফিস থেকে।

কাজী শাহেদ সম্পর্কে তখনও বিশেষ কিছু জানি না। শুধু এ টুকু জানি- কর্নেল পদ মর্যাদার এ লোকটি সেনাবাহিনীর ক্রয় বিভাগের মহাপরিচালক থাকা কালে এরশাদ আমলে চাকরি খুইয়েছিল দুর্নীতির কারনে। সংবাদ পত্রসেবীর সুবাদে পরবর্তীতে ইনি আওয়ামী লীগে ঢুকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য (বিকৃত হলেও) বানাতে শুরু করেন, এবং এক সময় নৌকার কাণ্ডারি হিসেবে যশোরে এমপি প্রার্থী হন। ঢাকায় এসে আমি এখন পদে-পদে শিখছি- নীতি ও নৈতিকতা নামক শব্দগুলো এখানে কতো অপ্রয়োজনীয়! আমার বই পড়ে রাজনীতি শেখা-জানা, এবং বাস্তবতা, কত আকাশ-পাতাল! এ যেন আখেরে চরিত্রহীনের আফসোস! হায়রে "টাকা", তোর জন্য মানুষ কতো বৈপরীত্য নিয়ে বসবাস করে!

চায়ের আড্ডা থেকে বেড়িয়ে চলে গেলাম নিতাই'দার অফিসে, মালিবাগ চৌরাস্তার মোড়ে। তার কাছে পরামর্শ চাইলাম- পত্রিকা অফিসে কোন ধরণের কাজ আমার জন্য মানানসই হবে। তিনি বললেন, আপনি যেহেতু পেশায় একেবারে নতুন, সেহেতু সহ সম্পাদকের কাজটি আপনার জন্য মানানসই হবে। রিপোর্টিং কাজে থ্রিল আছে, কিন্তু প্রয়োজন পর্যাপ্ত 'সোর্স'। যাতে করে আপনি ভেতরের খবরগুলো বের করে আনতে পারেন। আর ডেস্কে দেশিয় কিংবা আন্তর্জাতিক সংবাদ অনুবাদের কাজটি আপনার জন্য সহজ হবে।

ধানমন্ডি দুই নম্বর সড়কে জিগাতলা বাস স্ট্যান্ডে নেমে আজকের কাগজ অফিসে ঢুকে পড়ি। তখনও আসবাব-পত্র গোছ-গাছের কাজ চলছে। দেখি সম্পাদকের কক্ষে একটি লোক টুলের ওপর দাঁড়িয়ে বইয়ের তাকে বই রাখছে- সুদৃশ্য এন্সাইক্লপেডিয়া ব্রিটেনিকা। সম্পাদকের কক্ষ বলে কথা! আমার উঁকি দেয়াতে একটি লোক এসে জিজ্ঞেস করলো আপনি কার কাছে এসেছেন? বললাম- সম্পাদকের কাছে। বলল- বসুন। একটু পরে সম্পাদকের কক্ষ থেকে ডাক এলো। ঢুকে তাজ্জব- এতো সেই লোকটি, যে একটু আগে বই গোছাচ্ছিল। এতো দেখি চেংড়া বয়সের একটি লোক, আমার থেকে বড়জোর চার পাচ বছর বয়সে বড়। কোথায় কেজি মোস্তফা, আবু জাফর শামসুদ্দিন, সন্তোষ গুপ্ত, আল মুজাহিদি, রাহাত খান, অথবা বজলুর রহমান! আমি টাশকি খেলাম, কিন্তু মানিয়ে নিলাম এই ভেবে যে, পৃথিবীতে সব সময় পরিবর্তন আসে তারুণ্যের হাত ধরে।

নাঈম ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন- আপনি পত্রিকায় কাজ করতে চান, আমি বললাম নিশ্চয়। আপনি কি কাজ জানেন? আমি বললাম- আমি অনুবাদের কাজ করছি একটি এনজিও ম্যাগাজিনে। কাজেই আমি ডেস্কে সাব এডিটরের কাজ করতে পারবো। বেতনের কথা কিছুই সাব্যস্থ হলো না, নিয়ে গেলেন সরাসরি ডেস্কে। পুলক গুপ্ত'র সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন- ও কাজ করবে এখানে, পুলক তুমি দেখে নাও ও কাজ পারবে কি না! আহা কি আনন্দ। বাইরে মিছিল-মিটিং-এর তাড়া নেই। ভদ্র লোকের চাকরি। ডেস্কে মেরিনা, সুমি, টিপু, জাকারিয়া, অমিত হাবিব, আনোয়ার, টোকন ভাই সবাই তরতাজা তরুণ। সঞ্জিব চৌধুরী আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু, হবিগঞ্জ শহরে লেখাপড়া করা। সঞ্জিব'দা করতেন পত্রিকার পেছনের পাতায় 'ইথার থেকে' নামের একটি কলাম। তখনো জানতাম না সঞ্জিব গান করেন। আনিসুল হক কখনো এসে উঁকি দেন, তিনিও সহকারি সম্পাদক, মাথার চুল পুরোটাই কালো। একদিন দেখি আমার চট্টগ্রামের বন্ধু উত্তম সেন এসে হাজির। আঁকিয়ে উত্তম ছিলেন ফাইন আর্টসের ছাত্র। এখানে কার্টুন এবং ইলাস্ট্রেশন করবেন। রিপোর্টার সবাই তরুণ। আবু হাসান শাহরিয়ার করেন সাহিত্য পাতা। তখনো পুরো দস্তুর কবি নন। কিন্তু এখানে সবার বয়স তিরিশের নিচে। তসলিমা নাসরিনও আসেন। এক উদ্দাম জীবনের ছ'টা প্রতিদিন। তখনো ডামি বেরুচ্ছে, আনুষ্ঠানিক প্রকাশনা ২৬ মার্চ থেকে।

পত্রিকা বেরুলো। দিনে-দিনে এর সার্কুলেশন বাড়ে। এক সময় অভ্যন্তরীণ গোলযোগে ইত্তফাক মাস খানেকের জন্য বন্ধ হলে সার্কুলেশন লাফ দেয় ১ লাখ আশি হাজারে। আমাদের বেতনও বাড়ে। কিন্তু নাঈম ভাইয়ের জন্য দূর্যোগ ঘনিয়ে আসতে থাকে। পত্রিকার এক বছরের মাথায় ঢাক-গূড়-গূড় বাজতে থাকে। কাজী সাহেবের নাম শুনেছি, দেখিনি কোন দিন। তিনি নাকি আসবেন পত্রিকা দখল করতে? তিনিতো মালিকই। মালিক তার অফিসে আসবেন, এতে দখলের কি হলো? এর কিছুদিন আগে আবু হাসান শাহরিয়ার নাঈম ভাইয়ের সঙ্গে মতবিরোধে বেড়িয়ে গেলেন কাগজ থেকে দল-বল সহ। উত্তমও ছিল সে দলে। উত্তম আর আমি থাকতাম দু'জনে একটি বাসা করে, আজকের কাগজের পাশে। আমার অবসরের সঙ্গী বই আর একটি গীটার। উত্তমের- রঙ তুলি। গভীর রাতে ছাদে অথবা বারান্দায় দুজনেই এক সঙ্গে গীটার বাজিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত করা। কখনো তরুন-বয়স্ক লেখক-কবির আড্ডা জমত আমাদের দু'তলার এই ফ্লাটে। কাজেই আমার জন্য এ ধরণের দল ছোটাছুটি ছিল খুবই বিব্রতকর।

আমি কোন দলে যাবো? আর মনের দিক দিয়ে আমি কখনো দলবাজীর পক্ষে নই। আমি দলে চলতে ভালবাসি, কিন্তু দলবাজি ঘেন্না করি। দলবাজি সম্পর্কে পশ্চিম বাংলার লেখক কবি সমরেশ মজুমদারের একটি কথা আমি সব সময় মনে রাখি। আমাদের দেশে এরশাদের শাসনামলে দলবদ্ধ বুদ্ধিজীবীদের বিবৃতির প্রচলন ছিল। কলকাতায়ও এর প্রচলন শুরু হলে কেউ-কেউ বুদ্ধিজীবীদের স্বাক্ষর না নিয়েই "বুদ্ধিজীবীদের বিবৃতি" দেয়া শুরু করেন। এর বিরুদ্ধে প্রথম কলম ধরেন সমরেশ, তিনি বলেছিলেন- "জঙ্গলে ইতর প্রাণীরা দলবদ্ধ হয়ে খাবারের অন্বেষণ করে। কিন্তু বাঘ-সিংহ কখনো দলবদ্ধ হয়ে শিকার খুঁজে না।" তার এ বক্তব্যটি আমার খুব মনোপুত ছিল। দলবাজিতে সাময়িক লাভ হয়, কিন্তু সুস্থ চিন্তা, ব্যক্তি সাতন্ত্র্য, সৃজনশীলতা এবং মননশীলতা সবই লোপ পায়। আমার শিশুকালে, মা অনেক সময় আমাকে কোন কাজের নির্দেশ দিয়ে আমার বড় ভাইটিকে পাঠাতেন আমার পিছু-পিছু, কাজটি আমি ঠিকমতো করি কিনা দেখতে। তখন আমি বেঁকে বসতাম। বলতাম আমি যাবো না। হয় আমি একা যাবো, নয়তো যাব না। যাই হউক, এ আমার উইজডম, আমার সার্বভৌমত্ত।

একদিন যখন ঠিকই কাজী শাহেদ তার হাতের ছড়ি ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে আজকের কাগজে এসে গেলেন, তখন অনেকে দল-বলে নাঈম ভাইয়ের সঙ্গে বেড়িয়ে গেলেন। আনিসুল হকসহ প্রায় সবাই ছিলেন নাঈম ভাইয়ের দলে। আমি কি করবো ভেবে না পেয়ে বাসায় চলে গেলাম। উত্তম আর শাহরিয়ার ভাই অপেক্ষা করছিলেন আমার জন্য। উত্তম আমার আঁতে ঘা দিয়ে বলল- ভার্সিটিতে তুমি ছিলে জামাত-শিবির আর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আপোষহীন এক যোদ্ধা! আর এখানে কি না তুমি এদের পিছু-পিছু ছূটবে জীবিকার অন্বেষণে! তাই তো! এরা আমাকে নিয়ে গেল কাজী শাহেদের কাছে। জানতে চাইলাম- কি কারনে তিনি নাঈম ভাইয়ের বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নিলেন? কাজী শাহেদের অভিযোগ ছিল- নাঈম ভাই পত্রিকার মালিকানা আত্মসাৎ করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন, পত্রিকার আয়-ব্যয়ের কোন হিসাব দিতেন না, পত্রিকার সাবসিডিয়ারি ব্যবসাগুলোও কুক্ষিগত করেছিলেন নিজের ভাইকে দিয়ে। আর চিরাচরিত পন্থায় নারী ঘটিত অভিযোগও আনলেন কর্নেল সাহেব। তার কোন অভিযোগই আমার বিবেচ্য ছিল না। আমার বিবেচ্য ছিল একটি "প্রতিষ্ঠান"।

আমি আমার জীবনের প্রথম কর্মস্থল "আজকের কাগজ"কে দেখতে চেয়েছিলাম একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে। যা গড়ে উঠবে মেধা-বুদ্ধি-জ্ঞ্যান ও চিন্তার পথিকৃৎ হিসেবে। অসততার অভিযোগ কোন পক্ষ থেকে কারো প্রতি কাম্য ছিল না। মেধা কম থাকলেও কোন প্রতিষ্ঠান দাড়াতে পারে, কিন্তু অসততা থাকলে কখনো কোন প্রতিষ্ঠান দাঁড়ায় না। আমি আর নাঈম ভাইয়ের সঙ্গে যাইনি। কিন্তু দূর থেকে দেখলাম একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল ভোরের কাগজ, প্রথম আলো, কিংবা আমাদের সময়ের ক্ষেত্রে। এরপর আমি কাজ করেছিলাম বাংলাবাজার পত্রিকা এবং সর্বশেষ দৈনিক সংবাদে। বাংলাবাজারে আমার হৃদয় ও বুদ্ধি দু'টিই জখম হয়েছিল। সংবাদে কাজ করে প্রতিষ্ঠানে কাজের কিছু মেজাজ পেয়েছিলাম। কিন্তু মাস শেষে বেতন প্রদানে গড়িমসি দেখে আমার মনে হতে লাগলো- হায়, এ দেশে সবই বুঝি "ধর-মার-খাও" নিয়মে চলবে?

***
নিউইয়র্ক, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১১