অচীন পাখি- এক

জহিরুল চৌধুরী
Published : 19 Jan 2012, 02:55 AM
Updated : 19 Jan 2012, 02:55 AM

নিউইয়র্কের কেনেডি বিমান বন্দর। ২৮ ডিসেম্বর সকাল ন'টা। আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পর আবুধাবি'র এমিরেট এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ৮৪৬ ছেড়ে যাবে দুবাইয়ের উদেশ্যে। দুবাইয়ে পাঁচ ঘন্টা বিরতির পর ঢাকার উদেশ্যে একই এয়ারলাইন্সের ৮০২ ফ্লাইট ছাড়বে। হিসেবে দু'দিন হলেও দিবা-রাত্রির ব্যবধান বাদ দিলে প্রায় দেড় দিনের যাত্রাপথ।

লাউঞ্জে আরো অনেক যাত্রীর মতো আমরাও অপেক্ষার পালা গুনছি। কখন না বোর্ডিং পাসের ডাক আসে! সিকিউরিটির কড়াকড়িতে তিন ঘন্টা আগেই বিমান বন্দরে এসে উপস্থিত। জুতা-বেল্ট, পকেটের ওয়ালেট কিছুই নিরাপত্তার দাপট থেকে রেহাই পায়নি। সবচেয়ে অসস্থিকর ছিল জুতা-বেল্ট খোলা। মাত্র এই ক'বছরে আমার মতো নির্বিরোধ যাত্রীরা সন্ত্রাসের কাছে কতটা অসহায় হয়ে গেলো? ভাবনা আমাকে নিয়ে যায় এক যুগ আগে। কুয়ালালাম পুরে আমি, আমার স্ত্রী আর কোলের শিশু অনন্যা কেমন করে মাইল খানেক পথ দৌড়ে বিমানে উঠেছিলাম। আমাদের জন্য মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান অতিরিক্ত দশ মিনিট অপেক্ষা করেছিল। কার্গো'র দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লাগেজ এসেছিল পরের দিনের ফ্লাইটে। আজকের দিনে এসব কল্পনা মাত্র। এয়ারলাইন্সগুলোর কাছে যাত্রীরা এখন সন্দেহের, কখনো আতঙ্কের।

সম্ভবত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে এ বিশ্ব। কারন এখানে মানুষে-মানুষে ব্যবধান বেড়ে গেছে। এক দলের চালাকি কিংবা শোষণের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে আরেক দল। মানুষ মানুষকে পরাজিত করে বেঁচে থাকার কৌশল অবলম্বন করেছে। এক অসমান প্রতিযোগিতায় ছিটকে পড়ছে কিছু মানুষ। এরাই হেরে যাওয়ার যাতনা সইতে না পেরে আশ্রয় নিচ্ছে চোরাগোপ্তা হামলার, কিংবা আমাদের ভাষায় সন্ত্রাসের! উড়োজাহাজ, নৌ জাহাজ, কিংবা বড় দালান-কোঠায় হামলা- কোনটাই বিচ্ছিন্ন নয়!

যে নতুন পৃথিবী, আর নতুন বিশ্ব দর্শনের বাণী আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত সুনামীর মতো তরঙ্গায়িত হবে বলে আমার বিশ্বাস, তার কিছু আলামত আমি টের পাচ্ছি। প্রেসিডেন্ট ওবামা তা টের পেয়েছিলেন বলেই হয়তো নির্বাচনের আগে 'চেঞ্জ-চেঞ্জ' বলে চেঁচাচ্ছিলেন। কিন্তু পরিবর্তনের কোন আলামত সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র আমেরিকাবাসী দেখেনি ক্ষমতার কাঠামোই এমন। হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না! প্রেসিডেন্ট বদলে যেতে পারে, কিন্তু যে কাঠামোর উপর আমেরিকা দাঁড়িয়ে- তার পরিবর্তন হবে না। আব্রাহাম লিঙ্কনের সেই মর্মবাণী- ডেমোক্রেসি ফর দ্যা পিপল, বাই দ্যা পিপল, অফ দ্যা পিপলের জায়গায় দিনে-দিনে স্থান করে নিয়েছে ডেমোক্রেসি অফ দ্যা কর্পোরেট, বাই দ্যা কর্পোরেট, ফর দ্যা কর্পোরেট।

গণতন্ত্রের এমন ব্যবহারিক নিয়তির কথা জানলে গ্রীক দার্শনিকরা হয়তো তাদের এই আবিস্কার সম্পর্কে নতুন করে ভাবতেন। কিন্তু সে সুযোগ সম্ভবত আর নেই। কর্পোরেটগুলোর পেশী শক্তিতে ধর্মগ্রন্থের মতো অমোঘ হয়ে গেছে গণতন্ত্র। এখন এমন এক আঁধার- যখন 'গণতন্ত্র' আর গণ মানুষের হাতে নেই।

সাধারন মানুষ শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। তারা বোবা এবং ভাষাহীনও। কারন কর্পোরেট কব্জা করে নিয়েছে প্রচলিত মিডিয়াও। একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পারি নাইন-ইলেভেন পরবর্তিতে আমেরিকার গতি নির্দেশ করেছে এই মিডিয়া, অর্থাৎ পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন-রেডিও। পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টিতে আমেরিকার সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের সায় ছিল না। তথাপি এই যুদ্ধ আমেরিকার জন্য এক নতুন পরাজয় নিশ্চিত করেছে। তাহলো মানবিক এবং অর্থনৈতিক।

প্রেসিডেন্ট ওবামা যে কথা বলতে এবং যে কাজ করতে ভয় পাচ্ছিলেন, আজ সে কথাগুলোই নিঃশঙ্ক চিত্তে বলছেন রিপাবলিকান প্রার্থী রণ পল। একেই বলে সময়ের দাবি। তরুন ওবামা'র ভুলের মাশুল দিতে ৭৬ বছর বয়সের এক বৃদ্ধ আজ বাঘের হুঙ্কার ছেড়ে বলছেন- যুদ্ধই আমেরিকার জন্য শেষ অস্ত্র নয়! পল নির্বাচিত হলে পৃথিবীর সর্বত্র প্রায় ১৩০টি আমেরিকান ঘাঁটি সরিয়ে ঘরে নিয়ে আসবেন। এতে করে যেমন যুদ্ধের দামামা থেকে নিষ্কৃতি পাবে পৃথিবী, তেমনি লাঘব হবে আমেরিকার অর্থনৈতিক টানাপড়েন!

সংখ্যা লঘিষ্ঠ হয়ে ওবামা যেমন ইতিহাস তৈরি করেছিলেন, সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট হয়ে রণ পল'ও তৈরি করবেন আরেক ইতিহাস। বয়সের ভারে রণের কথা মুখে আটকে যায়, তাতে কী। আমেরিকার অগ্রসর তরুন সমাজ তাকে চিনতে ভুল করেনি। সিএনএন কিংবা গেলাপ পোলের হিসেবে রণ পল পিছিয়ে থাকলেও অন লাইনের হিসেবে এগিয়ে! সোশাল মিডিয়া ইন্টারনেট এখন গণ মানুষের অস্ত্র, বোবার ভাষা। এই অস্ত্র যেমন কালো ওবামার বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল, একইভাবে তা ঘটবে রণ পলের ক্ষেত্রেও।

মিট রম্নি'র কাছে প্রাইমারীতে রণ হেরে যাবেন, পরিবর্তন প্রত্যাশী আমেরিকানরা তা মনে করে না। মিট রম্নি'র পেছনে কর্পোরেট হাউজগুলো যতই অর্থ ঢালুক। রণের পেছনে থাকবে 'অকুপাই ওয়ালস্ট্রীটের' তরুণ দল। তারাই চাঁদা তুলে অর্থ যোগাবে রণ'কে। ২০১২ সালের নির্বাচন তাই আমেরিকার গতি নির্ধারক। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেনকে পরাজিত ও রক্তাক্ত করে যে আমেরিকা স্বাধীনতা ও মৈত্রীর পতাকা উর্ধে তুলে ধরেছিল, তা সমহিমায় টিকে থাকবে কি না, তাও নির্ধারিত হবে এ বছরের নভেম্বরে।