ইচ্ছে করলেই পারি

জহিরুল চৌধুরী
Published : 18 April 2012, 03:40 AM
Updated : 18 April 2012, 03:40 AM

একটি পুরনো প্রশ্ন নতুন করে, বার-বার করতে ইচ্ছে হয়। রাজনীতিবিদদের কাছে কোনটি বড়- অর্থের দাসত্ব, না ত্যাগের মহিমা? আমার খুব বাল্য বয়সে মফস্বল শহরে বেড়ে ওঠা। আমাদের ছোট্ট শহরটিতে সুন্দর-সুন্দর দোকান-পাট না থাকলেও ছিল ব্যাপক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। এমনকি আমি যে পাঠশালাটিতে নিয়মিত যাতায়াত করেছি, সেখানেও প্রতি শনিবার সকাল দশটা থেকে বারোটা-একটা পর্যন্ত চলতো শিশুদের ছড়া-গান এসব। আমাদের মধ্যে কে হিন্দু, কে বৌদ্ধ এ নিয়ে আমরা কখনো ভাবিত ছিলাম না। আমাদের কারো ঘরে কোন প্রকারের রেডিও-টিভি ছিল কি না তা নিয়েও কারো উৎকণ্ঠা ছিল না। জীবনের উচ্চাশা নিয়েও তাড়িত ছিলাম না। হাসি-আনন্দ-গান আর খেলাধুলোয় কেটেছে আমাদের শৈশবের দিনগুলো।

আমাদের স্টেডিয়ামের পাশের ছোট্ট শিরিশ তলার মাঠটি ছিল বরাবর ঐতিহাসিক। এখানে আসতেন এবং বক্তৃতা রাখতেন মৌলানা ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ। তাদের সঙ্গে কখনো বক্তৃতার সুযোগ পেতেন তরুণ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। যখন থেকে হাটতে শিখেছি, হবিগঞ্জের জালাল স্টেডিয়ামটি তখন থেকেই সবচেয়ে প্রিয় জায়গা।

আমরা জনসভায় বক্তৃতা শুনতে যেতাম। বক্তৃতার আগে বাউল আব্দুল করিম এবং অন্যান্য বয়াতের গান চলতো, তাতেও ছিল দারুণ আকর্ষণ! এসবই স্বাধীনতার পরবর্তি দিনগুলোর কথা। শহরের মধ্যবিত্তরা নিয়ন্ত্রণ করতো রাজনীতির গতিপ্রকৃতি। তাইতো স্বাধীনতার পরবর্তি অন্তত তিন দশক পুরো হবিগঞ্জে প্রগতিশীল রাজনীতিবিদদের প্রভাব ছিল অবিসংবাদিত। রাজনীতিটা যখনই টাকার কাছে জিম্মি হয়ে পড়লো, তখন থেকেই শুরু হলো এর কালো অধ্যায়। রাজনীতিবিদকে টাকা কামাই করতে হবে, অর্থে-বিত্তে বিলাসী জীবন-যাপন করতে হবে, এ ছিল কল্পনারও বাইরে। মনে পড়ে সে দিনগুলোতে অধ্যাপক মোজাফফর বলতেন- "আমরা সে সন্তানটিকেই চাই, যে ঘরের হবে না, হবে পরের। রাজনীতি করে যে হবে ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর!" দীর্ঘ দিন কুঁড়ে ঘর প্রতিক নিয়ে সুরঞ্জিত বাবুও ছিলেন সেই ভাসানী, মোজাফফর, পঙ্কজ ভট্টাচার্যদের যোগ্য উত্তরসূরী।

আজ পরিস্থিতি এমন জায়গায় দাড়িয়েছে যে, সুরঞ্জিত টাকার দাসত্ব করবেন না, এটাই যেন অস্বাভাবিকতা। বরং আর সবার সঙ্গে একই প্রতিযোগিতায় শামিল হয়ে নিজেও যত পারা যায় অর্থ-বিত্তের মালিক হবেন, দেশের অর্থ চুরি করে নিজের সন্তানের সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে দেবেন, এটাই যেন নিয়তি। তাইতো এ ঘটনার পর যখন শুনি- 'সবাই চুরি করছে, সুরঞ্জিত ভিক্টিম অব দ্যা সারকামস্টেন্সেস' তখন মনে হয় 'ধরণী দ্বিধা হও'। এমনকি রাজনীতিবিদরাই বলছেন- চুরি করাটাই যেখানে স্বাভাবিকতা, সুরঞ্জিত সেখানে যথেস্ট চাতুর্যের পরিচয় দেননি! হায় আল্লাহ, তাহলে রাজনীতিবিদ কেন? জেলের সব কয়েদীদের ছেড়ে দিন। বিশ্বাস করুন এরা আপনাদের চেয়ে বেশি জনদরদি হবে। এরা চুরি করবে, অন্তত ডাকাতি করবে না!

পরিশেষে বলতে চাই- আমরা কি পারি না আমাদের এ নিয়তি ঠেকাতে? নিশ্চয় পারি। পারেন ৩৩০ জন এমপি। যারা আইন প্রণয়ন করেন, সংবিধান ছুয়ে শপথ করেন সংবিধান রক্ষার। শপথ করেছিলেন সুরঞ্জিত সেন গুপ্তও। শপথ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াসহ সব এমপি এবং মন্ত্রী। এবং সংবিধানে শপথ ভঙ্গের অপরাধে কি শাস্তি ভোগ করতে হয়, তাও তারা জানেন খুব ভাল করেই।

আমরা প্রায়শঃ সাংবিধানিক শাসনের কথা বলি। কিন্তু সাংবিধানিক শাসন কি কেবল ক্ষমতার পালা বদলের জন্য, আওয়ামী লীগের পর বিএনপি, আবার বিএনপির পর আওয়ামী লীগ, না কি জনগণের শাসন কায়েমের জন্য? জনগণের শাসন বলতে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে বুঝি- জনগণের ইচ্ছায়, জনগণের জন্য শাসন। জনগণের 'সাংবিধানিক ক্ষমতা'কে পাহাড়া দেয়াই যদি রাজনীতিবিদের একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য হয়, তাহলে তো ব্যক্তিগত সার্থ হাসিল কিংবা লাভালাভের প্রশ্নই উঠে না!

এই আমি, আপামর জনসাধারণের একজন। আমার নির্দিষ্ট বাজেটের মধ্যে কায়ক্লেশে আমাকে দিন গোজরাণ করতে হয়। আমার নির্দিষ্ট আয়ের মধ্যেই আমি আনন্দ-বেদনা-হাসি-কান্নায় ভাসি। আমার কোন দুঃখবোধ নেই প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তি নিয়ে। আমার একটি নির্দিষ্ট আয়ুর মধ্যে আমাকে এই হাসি-কান্না-তামাশা ছেড়ে একদিন ধরা থেকে বিদেয়ও নিতে হবে, এটাই নিয়তি! আমি জানি গুলশান এক নম্বরের মোড়ে একজন বাদাম বিক্রেতাকে যেমন প্রতিদিনের জমা খরচা বাদ দিয়ে দু'শ টাকা বা তার চেয়েও কমে সুখী থাকতে হয়। আমি জানি একজন রিক্সা ওয়ালা সারা দিন অবুঝ জন্তুর মতো প্যাডেল ঠেলে, দিনশেষে পকেটে কিংবা গাঁটে তিন-চার'শ বা তারও কম টাকা নিয়ে মনের আনন্দে ঘরে ফেরেন। তাহলে আমি কেন ডাকাতিতে শামিল হবো, কিংবা ডাকাতদের নির্ঝঞ্জাট ডাকাতিতে সহযোগিতা করবো? আমার কি চাই- ত্যাগের মহিমা না কি অর্থের দাসত্ব? যদি শেষোক্তটাই আমার কাম্য হয়, তাহলে রাজনীতি অন্তত আমার জন্য নয়। সংবিধানকে লঙ্ঘনের জন্য যে শাস্তি আমাকে ভোগ করতে হবে সেটা অত্যন্ত ভয়াবহ এবং অবধারিত। বিশ্বাস ভঙ্গের অপরাধ আর যাই হউক অর্থদণ্ড, কিংবা কারাদণ্ডে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এসব রাজনীতিবিদকে রেহাই দিতে যত বড় আইনজীবীই এগিয়ে আসুন না কেন, জনগণ এখন অন্তত তাদেরকেও চিনে ফেলেছে।

নিউইয়র্ক, ১৭ এপ্রিল ২০১২