হায়রে বাংলা ভাষা!

জহিরুল চৌধুরী
Published : 26 April 2012, 03:04 PM
Updated : 26 April 2012, 03:04 PM

আমার বাবা ইংরেজীতে খুব দক্ষ ছিলেন। কিন্তু শুদ্ধ বাংলা ভাষা উচ্চারণ সম্পর্কে শৈশবে প্রথম দীক্ষা তার কাছেই। সম্ভবত বাবাকে প্রশ্ন করেছিলাম- আমাদের উচ্চারণ শুদ্ধ নয় কেন। এর জবাবে বলেছিলেন-আমাদের উচ্চারণ শুদ্ধ নয় এ কারনে যে, যারা বাংলা ভাষাকে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, তারা একটি আদর্শ উচ্চারণ এবং বাঁচন ভঙ্গী অনুসরণ করতেন। কালক্রমে এটিই বাংলা ভাষার উচ্চারণ রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার কাছে শেষ প্রশ্ন ছিল- সেই স্থানটি কোথায়, যে স্থানের উচ্চারণকে আদর্শ স্থানীয় মনে করা হয়। ব্রিটিশ ভারতে শিক্ষালাভকারী বাবা এর উত্তরে বলেছিলেন- 'নদীয়া শান্তিপুর'।
স্কুল জীবনে বাংলা ভাষায় নাটক, কবিতা, গান করার সময় শুদ্ধ উচ্চারণ নিয়ে কখনো বেগ পেতে হয়নি। তাই বাবার নদীয়া শান্তিপুরের বিষয়টি নিয়ে আর মাথা ঘামাতে যাইনি। ১৯৯২ সালে যৌবনের শুরুতে পেশাগত কাজে ভারতের পশ্চিম বঙ্গে, একই সঙ্গে দেশের বাইরে যাবার প্রথম সুযোগ। আসলে গিয়েছিলাম নেপালের কাঠমাণ্ডুতে মানবাধিকার সংক্রান্ত এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি আঞ্চলিক সেমিনারে। ফেরার সময় প্লেনের টিকিট ব্যাগের কোণে ফেলে রেখে রওয়ানা দিয়েছি সড়ক পথে। ততদিনে জুল ভার্নের "রাউণ্ড দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ" পড়া হয়ে গেছে। এখনো স্থল পথে বেরোনোর এক দূরন্ত নেশা। কাঠমান্ডু থেকে সড়ক পথে বাংলাদেশ আসার আরকটি কারণও ছিল। সেটা হলো- আমি একটি সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম নেপালের প্রধান বিরোধী দলের নেতা (কমিউনিস্ট পার্টির)মন মোহন অধিকারীর (পরবরতীতে প্রধানমন্ত্রী)। নেপাল-বাংলাদেশ যোগাযোগের ব্যাপারে তাকে একটি প্রশ্ন করেছিলাম। প্রশ্নের উত্তরে তিনি কাঁকড় ভিটা হয়ে ভারতের অভ্যন্তরের ১০ মাইল কোরিডর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের একটি সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন ব্রিটিশ আমলে অবিভক্ত ভারতে এই পথেই নেপালীরা বাংলাদেশে আসতো জীবিকা অন্বেষণে। যাই হউক, এই সড়ক পথের বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণও ছিল আমার বোহেমিয়ান ভ্রমণের আরেক উপলক্ষ।

কাঠমান্ডু থেকে পর্বত সঙ্কুল পথ পেড়িয়ে, সমতলের দীর্ঘ যাত্রা- প্রায় আঠারো ঘন্টা শেষে পৌঁছলাম কাঁকড় ভিটায়। ভারতের ভিসা নিয়েছিলাম কাঠমান্ডু থেকে। কাজেই ভারত ভ্রমণে কোন অসুবিধা নেই। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে শিলিগুড়ি, সেখান থেকে দার্জিলিং। দার্জিলিং-এ কয়েক দিনের নির্ঝঞ্জাট বেড়ানো এবং জিএনএলেফ-এর নেতা সুভাস ঘিসিং-এর সাক্ষাৎকারের নিস্ফল চেষ্টা। এরপর একমাত্র এসাইনমেণ্ট- বাংলা ভাষার উচ্চারণ রীতির উৎস খোঁজা। এজন্যও বেছে নিলাম সড়ক পথ এবং লোকাল বাস। দার্জিলিং থেকে লোকাল বাসে উঠলাম। গন্তব্য কলকাতা। উদ্দেশ্য- বাস যে সব স্টপেজে থামবে, আমিও সে সবে নামবো, এবং সাধারণ মানুষের উচ্চারণ এবং বাঁচন ভঙ্গী পরখ করবো। কিছু-কিছু স্টপেজের নাম এখনো মনে আছে- ডালখোলা, সুলতান গঞ্জ, মালদহ, বরহম পুর, এরপর নদীয়া জেলার শান্তিপুর। বাস এখানে মাত্র কয়েক মিনিট থামলো। এর ফাঁকে চায়ের দোকানে গিয়ে মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। শুনি- তাদের উচ্চারণ ভঙ্গী। মন ভরে যায়। বাবা আমার তখনো জীবিত। বাবাকে জানিয়েছিলাম- আমার এ অ্যাডভেঞ্চারের কথা। বাবা বলেছিলেন- পাগল কোথাকার!

কলকাতায় গিয়ে হোটেলে থাকি। পার্ক সার্কাসে মধ্যম মানের, কিন্তু বনেদি হোটেল। এর ম্যানেজার মধ্য বয়সী। খাতাপত্রে নাম দস্তখত রেখে কথা শুরু করলেন শান্তি নিকেতনি শুদ্ধ উচ্চারনে। শুনতেই ভালো লাগে। এরপর তিন দিন কলকাতায় বাসে, ট্রামে, হেটে পথ চলা। মানুষের সঙ্গে কথা বলা। কলেজ স্ট্রীটে বাংলাদেশের আদি বাসিন্দা কয়েক জন বইয়ের ব্যবসায়ীকে পেয়ে বিকেলের আড্ডায় মেতে ওঠা! আমার সবচেয়ে ভাল লাগে- সুন্দর করে মানুষের কথা বলার ধরণ! স্কুল কলেজ ছুটি হলে ছাত্র-ছাত্রীদের মুখে কিন্তু আর বাংলা ভাষা শোনা যায় না। আমি ইচ্ছে করে স্কুলগুলোর সামনের রাস্তায় হেঁটে যাই- উদ্দেশ্য ছাত্র-ছাত্রীদের মুখে বাংলা ভাষা শুনতে। হায়, তারা কেউ বাংলা ভাষা বলে না। তারা ট-ট-ড-ড করে ইংরেজী ভাষা বলে!

এরপর, আরো কয়েক বার কলকাতা গেছি। যতবারই যাই, দেখি- কলকাতা আরো বেশি 'ইংলিশ' হয়ে যাচ্ছে। ১৯৯৬ সালে কলকাতা বই মেলার থিম কান্ট্রি ছিল বাংলাদেশ। শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেছিলেন সে মেলা। আমরা ঢাকা থেকে বাস ভর্তি হয়ে গিয়েছিলাম সেই মেলা কভার করতে। মেলা উদ্বোধন শেষে রাইটার্স বিল্ডিং-এ আমাদেরকে সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন মূখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। একটি মাত্র প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছিলাম, এবং তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম- কলকাতার স্কুল কলেজগুলোতে বাংলা ভাষার চর্চার ব্যাপারে। জবাবে তিনি স্বীকার করেছিলেন- জীবিকার তাগিদেই মানুষ ইংরেজী শিক্ষার দিকে ঝুকে পড়েছে।

বাংলাভাষা নিয়ে আরেকটি আলোচনার কথা আমার সারা জীবন মনে থাকবে। ১৯৯৯ সালে চীনা বিপ্লবের ৫০তম বার্ষিকীর অনুষ্ঠান থেকে দেশে ফেরার পথে। বাংলাদেশ থেকে আমরা পাঁচ জন গিয়েছিলাম চীনাদের খরচে। নিউ এজের নুরুল কবীর ভাইও ছিলেন। বাকি একজন ছিলেন বাসসের, আরেক জন ডেইলি অবজারভারের। একজন গিয়েছিলেন সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা ক্যাটাগরিতে। যাই হউক, আমাদের এ উড়ো আলোচনায় আমি বলেছিলাম- ওদের শুদ্ধ উচ্চারণ রীতি দেখে দেখে আমরা যখন শুদ্ধ করে বাংলা ভাষা শিখলাম, তখন ওরা বাংলা ভুলতে বসেছে। দুর্ভাগ্য আমাদের বলতে হবে। গত ডিসেম্বরে দেশে যাওয়ার পর ঢাকায় আমার এক বন্ধু দুঃখ করে বললো- " কি বলবো আপনাকে, আমার সন্তান দুটোর একটিও বাংলা লিখতে পড়তে জানে না। তারা টিভি দেখে, হয় ইংলিশ, নয়তো মায়ের সঙ্গে হিন্দি। ঘরে কথা বলে আধো ইংলিশে।" এ দুঃখ কার, আমার না আমাদের!

নিউইয়র্ক, ২৬ এপ্রিল ২০১২