অতঃপর ভাই সমাচার

জহিরুল চৌধুরী
Published : 3 May 2012, 03:39 AM
Updated : 3 May 2012, 03:39 AM

ছাত্র সংগঠনের কর্মী হিসেবে মিছিল মিটিং-এ আন্দোলিত হওয়ার সময় ভাবতাম হায়- এদেশে সাংবাদিকরা, বিশেষ করে ইত্তেফাকের সাংবাদিকরা যদি সৎ এবং সাহসী হতেন, তবে দেশের অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যেত। ইত্তেফাক বললাম এ কারনে যে, জন্মের পর থেকে ঐ পত্রিকাটির সঙ্গেই প্রথম পরিচয়। এখনো এই পত্রিকাটি না পারি ছাড়তে, না পারি গিলতে। কারন এর রিপোর্ট এখনো অনেক তথ্য সমৃদ্ধ। সংবাদ এরচেয়ে পুরনো হলেও সাধারন পাঠকের কাছে এর আবেদন ছিল অনেক কম, ছাপার মানও ছিল এর একটি বড় কারন। এরশাদের স্বৈর শাসনের সময় ইনকিলাব বের হয়। আরো ঝকঝকে হয়ে। কিন্তু রাজাকারীর কারনে এর গ্রহণযোগ্যতা ছিল না আমাদের পরিবারে কোনদিন। এমন কি আমার বাবার কাছেও না।

দেশের অনেক সমস্যা বলতে একটি সমস্যাই ছিল আমাদের সামনে প্রকট, আর তা হলো দেশের স্বৈরাচারী ব্যবস্থা। দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ইত্তেফাক কখনো সহায়ক ছিল না। ১৯৮২ সালে এরশাদের সামরিক শাসন জারি হওয়ার সময়কালেও ইত্তেফাক উস্কানি দিয়েছে। আবার ইত্তেফাকের সম্পাদক আনোয়ার হোসেনও ছিলেন এরশাদের মন্ত্রী। এছাড়া ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পূর্ববর্তি সময়কালে ইত্তেফাকের রিপোর্ট এবং উপসম্পাদকীয় উৎসাহিত করেছিল বিপদ্গামী সামরিক অফিসারদের। আবার এরশাদের সামরিক শাসনের সময় ইনকিলাব বরাবর সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কানি দিয়েছে। এতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে চিড় ধরেছে, লাভ হয়েছে এরশাদের।

ছাত্র জীবন শেষে যখন সংবাদ পত্রের কর্মী হলাম, তখনই জানলাম- সাংবাদিকতা একেবারে নিস্ফলা চাকরি নয়। এখানে চাকরি করে স্টক এক্সচেঞ্জের নির্বাহী বোর্ডে মেম্বার হওয়া যায়। বাড়ি-গাড়ির মালিকতো হওয়া যায়ই। আর ঠিক মতো নেতাদের জুতো খুলতে জানলে মন্ত্রী হওয়াও 'দিল্লি দুরস্ত' নয়। যেমনটা তাহের উদ্দিন ঠাকুর করতেন বিভিন্ন জনসভার মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর জুতো খুলে দিয়ে। তিনি সে সময় তথ্য মন্ত্রীও হয়েছিলেন, আবার বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রে ঘোটও পাকিয়েছিলেন। এরশাদের জমানায়ও একজন সমাজতন্ত্রী সাংবাদিক-রাজনীতিবিদ তথ্য মন্ত্রী হয়েছিলেন। তার নাম ছিল সিরাজুল হোসেন খান।

উপরে যেসব তথ্য দিলাম, তা আমার জানা। কিন্তু একটি তথ্য আমার জানা ছিল না যে, সাংবাদিকরা রাজাকার-আলবদর কমান্ডারদের 'ভাই-ভাই' বলে মুখে একবারে ফেনা তোলেন! আমি তখন সংবাদপত্রের রিপোর্টার। রিপোর্ট সংগ্রহ করাই আমার পেশা। চোখ বুজে রিপোর্ট সংগ্রহ, কোন মতাদর্শ ও রাজনীতির ধার না ধেরে। তথাপি আমার খটকা লাগে- জামায়াতে ইসলামীর কোন নেতার সাক্ষাৎ নিতে, তাদের মগবাজারের কারখানায় গিয়ে সভা কভার করতে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় শিবিরের উৎপাতে এতটাই অতিষ্ঠ ছিলাম যে, এদের নাম উচ্চারণ করতে পর্যন্ত আমার ভয় এবং ঘৃণা দুটোই হতো। অথচ আমার সম্পাদকদের দেখতাম টেলিফোনে 'কাদের ভাই, কাদের ভাই' বলে একেবারে গলায় ঝুলে পড়তে। কারন কাদের মোল্লা ছিল জামায়াতের প্রচার সম্পাদক। আমার আশ্চর্য লাগতো, ঘেন্না হতো। কিন্তু মুখে বলার কিছু ছিল না। কারন আমি সাংবাদিক- দল-মত বলতে আমার কিছুই নেই!

আমার জন্ম মুক্তিযুদ্ধের কিছু আগে। আমার পরিবার- মা, বাবা, ভাই বোন সহ সবাই আমরা পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেছি পাকিস্তানী হায়েনাদের থেকে, একইভাবে তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরদের হাত থেকে। জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা সম্পর্কে আমার মনে বিন্দু মাত্র সন্দেহ ছিল না। কারন ইসলাম রক্ষার নামে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানীদেরকে সব রসদ জুগিয়েছে। আজ যখন বাচ্চু রাজাকার, কাদের মোল্লা, আলী আহসান মোজাহিদ, মতিউর রহমান নিজামী, গোলাম আযম গংদের বিচার হচ্ছে- তখন মনে মনে এই ভেবে সান্তনা পাই, অন্তত আমার জীব্দশায় এই হায়েনাদের বিচার দেখে যেতে পারছি!
এই বিচারের সুবাদে এ দেশের তরুণ প্রজন্ম জানতে পারছে রাজাকার-আলবদরদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের কথা। মিরপুরে কাদের মোল্লার এমনি এক লোম হর্ষক ঘটনার খবর পড়ে স্থির থাকতে পারলাম না। তাই লিখে ফেললাম।

আজ একটি অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে এই লেখার ইতি টানবো। ১৯৯৪ সালের এক বিকেলে আমার এসাইনমেন্ট ছিল মগবাজারে জামায়াতে ইসলামীর অফিসে একটি কর্মী সভা কভার করার। নিজামী ওই সভার প্রধান বক্তা। সভার ফাঁকে মাগরিবের বিরতি। এই বিরতির ফাঁকে উপস্থিত রিপোর্টারদের জন্য চা-বিস্কুটের আয়োজন। টেবিলের চার পাশে আমিসহ জনা দশেক রিপোর্টার বসা। নিজামীও বসেছেন আমাদের সঙ্গে। নিজামী তখন নিজ হাতে লাল গ্লকোজের প্যাকেটটি ছিঁড়ে বিস্কুট সাজিয়ে রাখছেন তস্তরির উপর। গ্লকোজের প্যাকেটটি খুললেই উপড়ের দিকে তিন-চারটে বিস্কুট এমনিতেই ভেঙ্গে যায়। ভাঙ্গা বিস্কুটগুলো নিজের হাতে নিয়ে আনাম বিস্কুটের তস্তরি এগিয়ে দিলেন আমাদের দিকে। আমি কৌতুহলি হয়ে দেখলাম- নিজামী এই ভাঙ্গা বিস্কূটগুলোই নিজের মুখে পুড়ছেন। কিন্তু আমি আশ্চর্য হলাম না। কারন এটিই জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি। তাদের হিংস্র রাজনীতির বিপরীতে এই মুখোশটি পরিধান করেই হাজার-হাজার তরুণ মনকে শিবিরের পতাকা তলে নিয়ে আসেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েও দেখেছি- এভাবেই 'বড় ভাইয়েরা' নিরীহ ছাত্রদেরকে কাবু করতে!

নিউইয়র্ক, ৩ মে ২০১২