ভ্রমণঃ সিলেট টু শিলং-তিন

জহিরুল চৌধুরী
Published : 11 May 2012, 03:51 AM
Updated : 11 May 2012, 03:51 AM


২৭শে মার্চ, সোমবার

প্রকৃতির অপার দান কয়লা-চুনাপাথর

আমাদের ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন। আমরা ছুটে চললাম চেরাপুঞ্জির দিকে। মেঘালয় রাজ্য ট্যুরিজমের বাসে আমরা গাইডসহ ১৭ জন। গিরী পথে এঁকে-বেঁকে চলছে আমাদের বাস। প্রায় বিরাণ ভূমি। জনমানবের চিহ্ন নেই। এখানকার খনিজ সম্পদ প্রায় অনাবি®কৃত। চলতি পথে ডানে-বাঁয়ে কয়লার খনি। পীট কয়লা, ইটের ভাটাসহ সব ধরনের জ্বালানীর কাজে ব্যবহৃত হয়। এখান থেকেই তামাবিল সীমান্ত দিয়ে আমাদের দেশে কয়লা আমদানি হয়। তামাবিল স্থল বন্দরে আমি বেশ কয়েকটি কয়লার ডিপোও দেখেছি।

এখানে কয়লা উত্তোলনের পদ্ধতিও সাবেকি আমলের- হস্তচালিত পুলির সাহায্যে। হাঙ্গামার ভয়ে যান্ত্রিক ও শিল্পসম্মত উৎপাদন নেই। স্থানীয় অধিবাসীরা ৪/৫ হাত গর্ত খুঁড়ে অল্প আয়োজনে, কিন্তু হাড়ভাঙ্গা খাটুনিতে আহরণ করছে এসব। এরপর তুলে দিচ্ছে বড়-বড় ট্রাকে। আবার কিছুদূর যাবার পর নজরে পড়লো চুনাপাথরের খনি। আমার ধারণা করতে অসুবিধে হয়নি ব্রিটিশ ঈস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি শুধু-শুধু চার-পাঁচ হাজার ফুট উপরে রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগ নেয়নি। আসামের খনিজ তৈল অবশ্য তখনই উত্তোলিত হতো কি-না আমার জানা নেই। এখানকার খনিজ সম্পদ তারা কাজে লাগিয়েছে ভারতের রেলওয়েকে চালু রাখার জন্য। আর সিলেট ছিল এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর আদায়ের কেন্দ্র। খনিজ সম্পদ ডিপোট করা হতো সিলেটে। শিলং ছিল সিলেট কালেক্টরেটের অধীন। এ কারনে চুনাপাথরের সাথে সিলেটের নাম জড়িয়ে আছে। অথচ ১৯৪৭ সালের রেডক্লিফ রোয়েদাদ অনুসারে সম্পদের পুরোটাই গেল ভারতের বরাতে।

মাঝে-মাঝে পাথরের যেসব কালো পাহাড় রক সদৃশ দাাঁড়িয়ে আছে সেগুলো দেখলেই বোঝা যায় মার্বেল অথবা গ্রানাইড লুকিয়ে আছে এর স্তরে-স্তরে। প্রশ্ন জাগে এই সম্পদের কারনেই কি ভারত সরকার উত্তর-পূর্ব ভারতকে ওপেন করতে চাননি বহির্বিশ্বের সামনে? এখনো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সেখানে ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা আছে।

বৃষ্টিপাতের রেকর্ডে চেরাপুঞ্জি নয়?

এক সময় পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হতো এই চেরাপুঞ্জিতে। বছরে প্রায় ৫০০ ইঞ্চি। আমাদের বই-পুস্তকে তাই লেখা আছে। কিন্তু গত পাঁচ বছর অর্থাৎ ১৯৯৬ সাল থেকে চেরাপুঞ্জির আকাশের মেঘ খানিকটা সরে গেছে ৫০ কিলোমিটার দূরবর্তী মাওসিনরামে। রেকর্ডপত্র থেকে জানা যাচ্ছে বিশ্বে এখন সর্বাধিক বৃষ্টি হচ্ছে মাওসিনরামে, বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ'শ ইঞ্চি। এ্যানি বিশদ ব্যাখ্যায় আমাদের এসব জানিয়ে দিল। কিন্তু দূর্ভাগ্য আমাদের- বৃষ্টি দূরে থাক, মেঘের টিকিটির দেখাও পেলাম না।

খাঁ-খাঁ রোদ। এ্যানি জানালো, জুন থেকে শুরু হয় অবিরাম বৃষ্টির ধারা। বজায় থাকে অক্টোবর পর্যন্ত। তবে আগস্ট পর্যন্ত মুষলধারে। অর্থাৎ আমাদের আষাঢ়, শ্রাবণ আর ভাদরে চেরাপুঞ্জি ভরা যৌবনা। পাহাড়ের খাদে ঢেলে দেয় তার বিপুল জলরাশি। তবে এই রোদ-বৃষ্টির মধ্যেও তাপমাত্রা থাকে সহনীয়, ১৫ থেকে ২০ সেন্টিগ্রেডের মধ্যে। অর্থাৎ আমাদের দেশের একপ্রকার শীত। চেরাপুঞ্জিতেই আমরা দেখলাম একটি বিশাল রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম। ১৯৩১ সালে নির্মিত এটি। স্কুল-কলেজ সবই আছে ওর ভিতর।

নহ-কা-লিখাই জলপ্রপাত

আমরা এখন চেরাপুঞ্জির হৃদয়ে। উচ্চতায় ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঝর্ণাধারার মুখোমুখি। এ্যানির ভাষায় প্রথমটি নাকি কর্ণাটকে। ঝর্ণার শো-শো শব্দ যেন গুমরে কাঁদছে। এই কান্না কি লিখাইর জন্য? ঝর্ণাধারাটির নামকরণ নিয়ে বাসে দাঁড়িয়ে একটি উপাখ্যানের বর্ণনা দিল এ্যানি। উপাখ্যানটি এ রকম- লিখাই নামে এক মহিলার একটি শিশু কন্যা ছিল। স্বামী-কন্যা নিয়ে তার সুখের সংসার। বিয়ের চার বছর পর হঠাৎ একদিন লিখাই'র স্বামী মারা গেল। পাড়ার লোকজনের কটু কথা আর পরিবারের গঞ্জনা বছর দুয়েক পর লিখাইকে ঠেলে দিল দ্বিতীয় বিয়ের পথে। যার সাথে বিয়ে হলো, সে ভালবাসতো লিখাইকে। কিন্তু দেখতে পারতো না লিখাই'র চার বছরের শিশু কন্যাটিকে। প্রায়ই মারধোর করতো। একদিন দুপুরে জঙ্গলে খড়ি কুড়োনোর কাজ থেকে ফিরে এসে লিখাই দেখে তার শিশুটি ঘরে নেই। স্বামী তাকে আদর করে ভাত-মাংস খেতে দিল। রান্না এতো ভাল হয়েছে যে, লিখাই ক্ষুধায় কাতর হয়ে আরো কয়েকটি বাড়তি টুকরা খেল। এরপর খুঁজতে বেরোয় শিশুটিকে। দুপুরের খরতাপে মেয়েটিকে খুঁজে-খুঁজে হয়রান। পথে ময়লার স্তুপে লিখাই কয়েকটি আঙ্গুল পেলো। পাড়ার একজন বললো দুপুরের বেশ কিছুক্ষণ আগে সে মেয়েটির কান্না শুনতে পেয়েছে। লিখাই'র আর বুঝতে বাকি রইল না ক্ষুধার তাড়নায় সে কার মাংস খেয়েছে! লিখাই আর বাড়িতে না ফিরে ছুটে গেল ঝর্ণাধারার দিকে। প্রায় ছয়'শ ফুট পাহাড়ের উপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করলো লিখাই। সেই থেকে মানুষ এই ঝর্ণায় লিখাই'র কান্না শুনতে পায়। আর আদর করে মানুষ এই বিশালাকৃতির ঝর্ণাটির নাম দিয়েছে লিখাই'র চুল বা নহ-কা-লিখাই।

এ্যানি জানালো ভরা বর্ষায় এ ঝর্ণার পানির ধারা বিছিয়ে পড়ে মাটিতে। নারী যেমন এলিয়ে দেয় তার চুল। দ্যা গ্রেট নায়েগ্রার মতো এর ভয়ঙ্কর শব্দ শোনা যায় কয়েক মাইল দূর থেকে। কূপের লেবেল থেকে এর আসল উচ্চতা ১৭৫ মিটার। ফলে শব্দ আর ধোঁয়াশা (মিস্ট) মিলে এক মায়াবতীর রূপ। শ্রাবণের ভরা পূর্ণিমায় নাকি লিখাইকে এখনো দেখা যায় সাদা বসনে ঝর্ণার আশেপাশে আনমনে ঘুরে বেড়াতে! লিখাইর পরিণতি হৃদয়কে নাড়া দেয়!

যাই হোক, এখান থেকে আমরা মধু কিনলাম দুই বোতল। গণতান্ত্রিক বিধান মতে একটি মায়ের, আরেকটি শ্বাশুড়ীর জন্য। এক বয়স্ক মহিলা ঘরের চাকে তোলা মধু বিক্রি করেন। একেবারে একাকি এই মহিলা থাকেন ঝর্ণা থেকে সামান্য কিছু দূরে। পর্যটকদের জন্য এখানেও বেশ কয়েকটি দোকান রয়েছে। যেগুলোতে হালকা এবং কড়া সব ধরণের পানীয়ই পাওয়া যায়। এখান থেকে আমরা গেলাম মাওসমাই গুহায়।

(ভ্রমণ কাল ২০০০ সাল)