মূল্যবোধ এবং একজন প্রাচীন শিক্ষক

জহিরুল চৌধুরী
Published : 31 May 2012, 04:35 AM
Updated : 31 May 2012, 04:35 AM

দেশে খুন-সন্ত্রাস আর রাহাজানির সংবাদে আমার এখন আর পিলে চমকায় না। রমনা বটমূলে বৈশাখীর অনুষ্ঠান, পল্টনে সিপিবি'র সমাবেশ এবং যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা মেরে ডজনে-ডজনে মৃত্যু উপত্যকা পাড়ি দেয়ার পর মৃত্যু আমাকে আর আহত করে না। এমনকি কোন সংবাদ কর্মীর আহত কিংবা মৃত্যুর ঘটনাও আমাকে সাময়িক পর্যুদস্ত করে, কিন্তু একেবারে মুষড়ে দেয় না। কারন আমি জানি আমাদের এ সমাজ মৃত্যু পথযাত্রী। সমাজের মানুষকে আমরাই বিধ্বস্ত ও বিপন্ন করে দিয়েছি।

আমাদের সমাজের এই করুণ দশার জন্য হয়তো অনেক কিছুকেই দায়ী করা যাবে। তবে সবচেয়ে বড় কথা- বস্তু জগতের প্রতি আমাদের তীব্র বাসনা সামাজিক বন্ধনকে একেবারে আলগা করে দিয়েছে। ধনী আর নির্ধনের বিস্তর সামাজিক বৈষম্যকে আমরা উস্কে দিয়েছি। সামাজিক ন্যায়-বিচারের স্থলে আমরা স্থান দিয়েছি সবলের শাসনকে। পরশ্রী কাতরতাকে আলিঙ্গন করে মৈত্রী ও মমতাকে আমরা পাঠিয়েছি নির্বাসনে। এক সময় আমাদের এই দেশে মানুষের মৃত্যু হতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে। গোরকী, বন্যা, ঝড়-জলোচ্ছাসে মৃত্যুর বিভীষিকা পাড়ি দিলেও মানুষ সৃষ্ট দুর্যোগ আমাদের জীবনকে আজ ভয়াবহ বিপদের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। ক্ষমতার বলয়ে সৃষ্ট অবিশ্বাস আর স্বার্থপরতা গ্রাস করে ফেলেছে আমাদের প্রতিটি কঠিন অর্জনকে। অথচ রক্ত আঁখরে লেখা আমাদের এসব অর্জনের পেছনে ছিল হাজার-হাজার মানুষের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ! রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- 'স্বার্থ মগ্ন যে জন বিমূখ বৃহৎ জগত হতে সে কখনো শেখেনি বাঁচিতে'।
আমাদের স্বার্থমগ্নতাই আমাদের বেঁচে থাকার সব শর্তগুলোকে আজ পূরণ করতে দিচ্ছে না।

যন্ত্রণার দায়
যে যন্ত্রণা আমরা বয়ে বেড়াই, তার দায় আমাদের শোধ করে দিতে হয় জীবদ্দশায়। মৃত্যুর পর মানুষের কোন দায় থাকে না। পিতার দায় পুত্র কখনো শোধ করে। তবে তা একান্তই নিজের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে। আর পিতার সেই দায় গুলোকেই সে আমলে নেয়, যে গুলো তার জীবন-যাপনের জন্য একান্ত আবশ্যকীয়। তাই তো জন্মের ঋণ শোধও মানুষের করতে হয় মৃত্যু দিয়ে।
আমার মতো অনেকেই প্রবাসে বাংলাদেশ নিয়ে ভাবে। অবশ্য প্রবাস আজ আর প্রবাস নেই। গোলকের এ প্রান্ত, অথবা ওপর প্রান্ত। একই আলো হাওয়া, একই মেঘ আর বৃষ্টি, এবং প্রকৃতির অপার দানে সবারি বেঁচে থাকা। বিজ্ঞানের উৎকর্ষও আজ সবার হাতের নাগালে। তথ্য প্রবাহও আজ এতোটাই উন্মুক্ত যে সত্যকে মিথ্যা বলে প্রতিষ্ঠা করা যেমন অসম্ভব, তেমনি সত্য-মিথ্যার তাল গোল পাকানোও দুঃসাধ্য ব্যাপার। কাজেই গত প্রায় দশটি বছর কিংবা তারো আগে থেকে বলা হয় গ্লোবাল ভিলেজের এক কঠিন নিয়মের মধ্যে আমরা আবর্তিত হচ্ছি। যেখানে সত্য প্রতিষ্ঠা গায়ের জোড়ে সম্ভব নয়। প্রয়োজন তথ্য এবং উপাত্ত।

বলা হতো ধর্মের কল বাতাসে ওড়ে। আমি বলি- এই একবিংশ শতাব্দিতে তথ্যের কল বাতাসে ওড়ে। অবাধ তথ্য প্রবাহকে গায়ের জোরে আটকে রাখার ক্ষমতা কারো নেই, তা সে যতই ক্ষমতাধর হউক। তাইতো এই শতাব্দীতে মানুষ আগের চেয়ে কয়েক'শ গুণ ক্ষমতাবান। স্বৈরাচারী এসব জেনেও না জানার ভান করে। তাদের জন্য বিপদ এখানেই। যে নতুন মূল্যবোধের আলোকে আমাদের এই ধরার সূর্যস্নান হচ্ছে, তাকে বাঁধা দেয়ার শক্তি কারো নেই। এটা যত আগে তারা উপলব্ধি করবে, ততই মঙ্গল!

তাকিয়ে দেখি স্বদেশে
যে দেশটি নিয়ে আমরা গর্ব করি, সে দেশে ১৬ কোটি লোক বাস করে, যার অর্ধেক চরম দারিদ্র্য সীমার নীচে। সে দেশে মানুষের মাথাপিছু আয় ৫শ ডলারের বেশি না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা ৫০ শতাংশের বেশি না। যে দেশে সরকারি বেসরকারি মিলে অর্ধ শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যার একটিও বিশ্ব মানের তালিকায় অন্তত পাচশ'টির অন্তর্ভুক্ত নয়। যে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ফি বছর বেকার সৃষ্টি করে চলেছে। যে দেশের অন্তত অর্ধেক মানুষ দিনের প্রায় পুরো অংশ হাড় ভাঙ্গা খাটুনিতে ব্যয় করে ন্যূনতম জীবন ধারনের জন্য খাবারের অন্বেষণে। সে দেশটি নিয়ে আমি ভাবি প্রতিদিন, হৃদয় তাড়িত হয়ে নয়। জন্মের ঋণ শোধের জন্য!

কিছু উদাহরণ
আমাদের দেশে সামাজিক ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের খড়গ হাতে তুলে নিয়েছিলেন রবীন্দ্র এবং নজরুল দু'জনেই। একজন সনাতন হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ব্রাহ্ম মতবাদ গ্রহণ করে নিজের সমাজে শুরু করেছিলেন প্রতিবাদ, আরেক জন প্রমিলা দেবীকে বিয়ে করে ধর্মের বেড়া ভেঙ্গে করেছিলেন অসাম্প্রদায়িকতার জয়গান! জীবিত উদাহরণও আছে আমাদের দেশে, আমাদের সামনে। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের উন্নয়নে এরশাদ জমানায় পাওয়া উত্তরার প্লটটি বেঁচে দিতে হয় অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবুসায়ীদকে। অথচ এই জায়গা জমির জন্য আমাদের দেশের অনেক বরেণ্য মানুষ কী না হা পিত্যেশ করে! এই একটি প্লট-ফ্ল্যাটের জন্য গায়ের সব কাপড় খুলে পা মুছে দিতেও কার্পণ্য করেন না! তাহলে মানবতা, আর মানবিক মূল্যবোধ জাগবে কিভাবে?

আমার এ কথাগুলোকে অনেকে বলেন সুবিধাবাদীর বয়ান। কিন্তু ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে নিজের শ্রম-ঘাম ছাড়া পৃথিবীর আর কোন কিছুর প্রতি ভরসা করি না। আমার এ ভরসা যদি ঈশ্বরের বন্দনা হয়, তাও মেনে নেই। যদি না হয়, তাও মেনে নেই।

সর্বশেষ চীনের মহান প্রাচীন শিক্ষক লাও জি'র দর্শন তত্ত্ব থেকে উদ্ধৃতি টেনে এ লেখার ইতি টানবো। আড়াই হাজার বছর আগে মহাচীনে মানুষে মানুষে বিবাদ বিসম্বাদ বেড়ে যায়। এই লাও জি পায়ে হেঁটে, কখনো মহিষে সওয়ার হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন মহাচীনের পথে প্রান্তরে। রাজা-মহারাজ থেকে শুরু করে নিরন্ন কুটিরে পর্যন্ত তিনি ঘুরেছেন দ্বারে-দ্বারে আর বলেছেন সাম্য-মৈত্রী আর মানবতার কথা। তার বাণী চীনে অন্য দু'টি দার্শনিক তথ্যের মতো সমান সমাদৃত। কালের পরীক্ষায় তার নাম করণ হয়েছে দাওইজম বা 'দ্যা ওয়ে'।

রোমান সাম্রাজ্য থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত তার শিক্ষা বিস্তৃত হয়েছে উপাখ্যানের মতো। আহমদী সম্প্রদায়ের কাদিয়ানী মুসলমানরা তো বলেই ফেলেছে- ইসলামের মর্ম বাণীর সঙ্গে দাওইজমের কোন পার্থক্য নেই। তাইতো হজরত মুহাম্মদের পাশাপাশি সমান শ্রদ্ধায় তারা স্মরণ করে লাও জি'কে। লাও জি বলেছিলেন- 'তোমার বেলায় তুমি তাই আশা করো, যা তুমি অন্যের বেলায় প্রদর্শন করো'।

নিউইয়র্ক, ৩০মে ২০১২