মানবাধিকার ঘোরে আচ্ছন্ন আমরা যখন পাশবিক হত্যাকাণ্ডে নির্বিকার এবং একটি সভ্যতার গল্প

জামান বাবু
Published : 29 July 2012, 07:17 AM
Updated : 29 July 2012, 07:17 AM

মানবাধিকার-ঘোরে আচ্ছন্ন আমাদের কি মনে আছে বছরখানেক আগে ?………………..
২৭ জুলাই, ২০১১ নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জে টেকের বাজার সংলগ্ন এলাকায় ভোর বেলায় গণপিটুনিতে ছয় ডাকাত নিহত হয়, এলাকাবাসী উত্তেজিত। এটি মূল ঘটনা নয়, অনুষঙ্গ। এবার আসা যাক মূল ঘটনায় –

" বেলা আনুমানিক সাড়ে ১০টার দিকে টেকের বাজার তিন রাস্তার মোড়ে একটি পুলিশ ভ্যান থেকে এক কিশোর কে উত্তেজিত জনতার মাঝে নামিয়ে দিয়ে তাকে ভোর বেলায় গণপিটুনিতে নিহত ডাকাত দলের সদস্য উল্লেখ করে পিটিয়ে মারার প্ররোচনা দেয়া হয়। ভোর বেলায় ডাকাত মারার ঘটনায় জোশে থাকা বীর জনতা (!) পাশবিক হিংস্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শুরু করে কিল ঘুসি, ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে দেয়। কিছুক্ষনের মধ্যে মৃত্যু হয় ছেলেটির। মৃত্যু নিশ্চিত করে পুলিশ নিথর দেহ টেনে তোলে গাড়ীতে। লাশটিকে বসার ভঙ্গিতে রেখে থানার দিকে নিয়ে চলে যায় । "

ঘটনাটি এখানেই শেষ হওয়ার কথা। হল না। কেউ একজন নৃশংস পুরো ঘটনা মোবাইলে ভিডিও করলেন। ঘটনার ১১ দিন পর ভিডিও টি নিয়ে সময় টেলিভিশন সংবাদে একটি প্রতিবেদন দেখানো হয় এবং এর পরদিন প্রথম আলো সহ দুয়েক টি মিডিয়ায় তা প্রকাশিত হয়। প্রশাসনের টনক নড়ে। তদন্তে বেরিয়ে আসে গণপিটুনিতে নিহত ছেলেটির নাম শামছুদ্দিন মিলন। ১৬ বছর বয়সের এই কিশোর চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে। যে টেকের বাজার এলাকায় তাকে পিটিয়ে মারা হয়েছিল তার মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দুরে চর ফকিরা গ্রামে তার বাড়ী। ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ন'টার দিকে জমি নিবন্ধনের ১৪ হাজার টাকা আর একটি মোবাইল ফোন সাথে নিয়ে ছেলেটি বাড়ী থেকে বের হয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামে চর কাঁকড়া উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন পুকুর ঘাটে তার খালাতো বোন চুমকির ক্লাশ শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। অপরিচিত মিলন কে দেখে স্থানীয় ইউপি সদস্য জামাল উদ্দিন এবং গ্রামবাসী জনৈক নিজাম উদ্দিন মানিক তার পরিচয় ও অবস্থানের কারন জানতে চান। এর মধ্যে স্থানীয় লোকজন অজ্ঞাত মিলনের উপর চড়াও হবার উপক্রমের এক পর্যায়ে তার খালাতো বোন চুমকি মিলনের পরিচয় নিশ্চিত করে। ইউ পি সদস্য জামাল উদ্দিনের ভাস্য মতে, জনসাধারণ ডাকাত পিটুনির ঘটনায় সেদিন উত্তেজিত ছিল বিধায় পরবর্তীতে কোন ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য মিলন কে তার সঙ্গে থাকা টাকা এবং মোবাইল ফোন সহ টহল পুলিশের জিম্মায় দিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ অপেক্ষা কৃত সংক্ষিপ্ত পথে থানার দিকে না যেয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে টেকের বাজার তিন রাস্তার মোড়ে যায় এবং এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটায়।

মিলনের মা কোহিনূর বেগম পুত্র হত্যার বিচার চেয়ে মামলা করেন ইউপি সদস্য জামাল উদ্দিন এবং গ্রামবাসী নিজাম উদ্দিন মানিককে আসামী উল্লেখ করে। মামলা চলছে মামলার পথে । চার্জশীট হয়নি এক বছরেও। কারন এসকল ক্ষেত্রেই আইন লাভ করে তার নিজস্ব গতি !

তবে, অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা অনেক বড় শাস্তি পেয়েছেন !! ঘটনা প্রকাশের পর বিভাগীয় তদন্তে প্রাথমিক ভাবে কর্তব্যে অবহেলার জন্য (!) দোষী সাব্যস্ত হন এস আই শেখ আকরাম হোসেন, কনস্টেবল আব্দুর রহিম ও হেমা রঞ্জন চাকমা এবং পরবর্তীতে কোম্পানিগঞ্জ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিক উল্লাহ। সাময়িক বরখাস্তে ছিলেন প্রায় আট ন'মাস, তারপর সবাই সপদে পুনরায় আসীন, তবে তাদের পদোন্নতি এবং বেতন বৃদ্ধি বন্ধ থাকবে !!! ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিক উল্লাহ বর্তমানে চট্টগ্রাম রেঞ্জের রাঙ্গামাটি থানার পরিদর্শক (তদন্ত)। উপপরিদর্শক মোঃ আকরাম শেখ স্বপদেই আছেন জেলার সেনবাগ থানায়। কনস্টেবল আব্দুর রহিম চৌমুহনী পুলিশ ফাঁড়ি এবং হেমারঞ্জন চাকমা চাটখিল থানায় আছেন। তাদের বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহারের একটি যুক্তি হচ্ছে বাদীর আর্জিতে তাদের নাম নেই।

প্রশ্ন উঠেছে কেন মিলন কে ডাকাত সাজিয়ে উত্তেজিত জনতার হাত দিয়ে মেরে ফেলা হল ? তার সাথে থাকা ১৪ হাজার টাকা আর মোবাইল ফোন হাতিয়ে নেয়ার জন্য নাকি খেয়ালের বশে একটু মজাও দেখতে চেয়েছিলেন পুলিশ মহোদয়রা ? পুলিশের হাতে পড়ার আগে মিলন তার মাকে ফোনে জানিয়েছিল কিছু লোকজন তাকে আটকে রেখেছে, যারপর মিলনের মা তার চাচাকে নিয়ে ঘটনা স্থলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়।

কোম্পানিগঞ্জের মিলন ও ঝালকাঠির লিমন। রাষ্ট্রীয় বর্বরতার শিকার দুই কিশোর। নারকীয় বীভৎস যন্ত্রণার তীব্রতা কোন ক্ষেত্রে বেশি – একেবারেই মরে যাওয়া নাকি বেঁচে থেকে প্রতি মুহূর্ত মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করা ? অবান্তর প্রশ্ন। তবে লিমন কিছুটা ভাগ্যবান। বেঁচে থেকে আর্তনাদ করতে পারছে বলেই এখন পর্যন্ত পাচ্ছে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা গুলোর সহানুভূতি। আর মৃত মিলনের স্তব্ধতায় বিবেক যেখানে ঘুমন্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আব্দুল কাদের বেঁচে থেকেই পেয়েছে উচ্চ আদালতের সমর্থন, নিজেকে প্রমান করতে পেরেছে নির্দোষ। আমিন বাজারে বেঁচে যাওয়া এক মাত্র ছেলেটি একা ছয় জনের কান্না কাঁদতে পারবেনা সত্যি, তবে জীবন নিয়ে ফিরেছে বলেই বন্ধুদের মুক্ত করতে পেরেছে ডাকাত অপবাদ থেকে, আর তাদের মামলাটির পরিণতি যাই হোক না কেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তালিকায় স্থানতো পেয়েছে ! এদেশে নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতে হলে বেঁচে থাকতে হবে ; মানুষের না কৈ মাছের জান নিয়ে মার হজম করে বাঁচতে হবে ; ধড় থেকে কল্লা আলাদা হলেও মরা যাবেনা।

অনেক দিন আগে কোথায় যেন পড়েছিলাম, সভ্য সমাজের এক লেখক নরমাংশভোজী (cannibal) জংলী কে জিজ্ঞেস করছে,
– মানুষ হয়ে শুধুমাত্র খাবার জন্য কিভাবে তোমরা মানুষ হত্যা করো ?
– আমরাতো খাবার প্রয়োজনে মানুষ মেরে ফেরে ফেলি কিন্তু তোমরা কি উদ্দেশ্যে এই ঘৃণ্য কাজটি করো ?
অসভ্য জংলীটির নির্ভেজাল স্বীকারোক্তির সাথে দৃঢ় কৈফিয়তে সেই মুহূর্তে অসহায় লেখক কোন জবাব খুঁজে পাননি…তাইতো (!)… সভ্য মানুষ কেন মানুষ খুন করে ???

ছবিঃ সময় টেলিভিশন/ দৈনিক প্রথম আলো