স্লোগান খোদিত সেই বোকা লাশকে বলছি

জামান বাবু
Published : 9 Nov 2012, 05:07 PM
Updated : 9 Nov 2012, 05:07 PM

আমরা মূলত পরস্পর বিরোধী দুই পক্ষ কিছু ক্ষুদ্রদের সাথে নিয়ে তখন একজোট ছিলাম। জনগণের স্বার্থ, গণতন্ত্রের মুক্তি, দেশোদ্ধারের দোহাই দিয়ে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষকে আমরা এক ছাতার নিচে নিয়ে এসেছিলাম। বোকা জনগণ বোঝেনি তখন অতীতে ক্ষমতার রস আস্বাদনে মোহিত আর অতৃপ্ত আমরা দুদল আমাদের চেয়ে ধুরন্ধর একজনের কাছ থেকে হারানো অমৃত ফিরে পেতে জাতীয় ঐক্যের সুর তুলেছিলাম। বোকাদের মধ্যে আরও বোকা, কলের পুতুলদের ভিড়ে আরও স্বয়ংক্রিয় পুতুল তোমরা কয়েকজন, তুমি একজন নূর হোসেন। নিজের পরিণতি জানো না, কি করলে কি হবে বোঝনা। শুধু জানো তোমার মতো লাখো ক্ষ্যাপাটে ৭১ এ যা করেছিলো, নিজের পরিণতি যাই হোক পরাধীন দেশটাকে পরিণত করেছিল স্বাধীন দেশে, সেরকম একটা কিছু করতে হবে।

আমরা বিব্রত হবনা নূর হোসেন। আমরা লজ্জিত হতে জানিনা। আমরা বিজয়ের হাসি হাসতে জানি। তবে কেন জানি সেই হাসি বেহায়ার হাসির মতো কর্কশ শোনায়। মজার বিষয় এ দেশের অর্বাচীন মানুষগুলোর কানে এই অশ্রাব্য হাসির শব্দকে প্রেরনাদায়ক সুমধুর মোহনীয় সঙ্গীত মনে হয়। তাইতো তারা মূর্খের দল বারবার এই সুর শুনতে চায়। তারা আমাদের বিজয়ী দেখতে চায়।

আমাদের অনুশোচনা থাকতে মানা। আমরা বড়জোর দুঃখিত হবার ভান করতে পারি। আমাদের যদি লজ্জাই থাকতো তবে কি এরকম হতে পারতো ?————-

"————–ওপারে সেই অপারেজেয় দানব, এদিকটাতে আমরা, তোমাদের মতো লাখো নূর হোসেন আমাদের ঘিরে। তোমরা চলছ আমাদের পেছনে না, সামনে। নিজেরা ঢাল হয়ে এগুচ্ছো। বোকার হদ্দ তোমাদের হাতে হাতিয়ার বলতে কিছুই নেই। আছে সাহস, না না দুঃসাহস। নিতান্ত অনুগত তোমরা এই মনিব আমাদের হাতে সিংহাসন তুলে দিতে মরিয়া। আমরা এর নাম দিয়েছিলাম "স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন"।

সামনে সেই প্রতিষ্ঠিত স্বৈরাচার এর বন্দুক, পেছনে আমরা। মধ্যখানে গোঁয়ার তুমি নূর হোসেন। উদোম গায়ে কি যে যেন আঁকাবুকি করেছিলে। তোমার মৃত্যুর পরে শুনেছিলাম, ওটা ছিল " স্বৈরাচার নিপাত যাক – গণতন্ত্র মুক্তি পাক "। তৃপ্তি পেলাম, ভালোই উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলাম তোমাদের। যাহোক, যা বলছিলাম, মধ্যখানে গোঁয়ার তুমি। একটা বন্দুকের গুলি এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল তোমার আঁকাবুকিটাকে। সেই সাথে তুমিও মরে গেলে।

তোমার সহযোদ্ধারা নাম দিল " শহীদ নূর হোসেন "। আমরাও লুফে নিলাম " শহীদ নূর হোসেন "। বাহঃ ভালোতো ! একটা লাশ পাওয়া গেল। তাও স্লোগান খোদাই করা " শহীদ লাশ "। এবার আরও সহানুভূতি আসবে, না তোমার জন্য নয়, তোমার দরিদ্র পরিবারের জন্য নয়, রাজ্য হারানো আমাদের দুদলের জন্য। তোমার সহযোদ্ধাদের আবেগটাকে আমরা উস্কে দেই, শোককে শক্তিতে পরিণত করার বুলি দিয়েছিলাম ওদের কানে। ওরা ফুঁসে উঠলো। জয় হল। সেটাও আমাদের, তোমার না……তোমার পরিবারের না……তোমার সহযোদ্ধাদের না। তোমরাতো হুকুম তামিল করেছিলে মাত্র। বড়জোর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ বলতে পারো।

যাকগে, তোমার মৃত্যুর কিছুটা পর পতন হয়েছিলো স্বৈরাচারের। তোমার লাশটাকে পদদলিত করে, তোমার রক্ত দুপায়ে মাড়িয়ে আমরা দুপক্ষই আলাদা ভাবে চুপিচুপি তোমার হত্যাকারীর কাছে গিয়ে বলেছিলাম, " বন্ধু আত্মসমর্পণ যখন করেছো ভাবনা নেই আর, এবার শুরু হবে আমার পালা, তুমি আমার দিকে থাকলে তোমার গায়ের প্রত্যেকটা লোম অক্ষত থাকবে, আমার সাথের ঐ যে আমার প্রতিপক্ষ, ওর কোন কিছু উপড়ানোর ক্ষমতা নাই "।

না না তাতে আত্মসম্মান যাবে কেন ? তুমি যে পিঠে খোদাই করেছিলে, " গণতন্ত্র মুক্তি পাক ", সেই মুক্ত গণতন্ত্রের চর্চা আমরা করেছিলাম। অবশ্য সেটা চারবার মোটামুটি ভাবে গ্রহণযোগ্য ভোটের আয়োজন পর্যন্তই যা দিয়ে আমরা পালা করে রাজ্য শাসন করেছি। হ্যাঁ রাজ্যইতো দেশ না। আবার সেই 'গণতন্ত্র' দিয়েই স্বাধীনতা বিরোধী এমপি-মন্ত্রী বানিয়েছি।

এত লজ্জা পেলে আমাদের চলবে কেন। আমাদের আমৃত্যু পণ যে ক্ষমতা, ক্ষমতা এবং ক্ষমতা। তুমি লজ্জিত হও নূর হোসেন। তুমি বিব্রত হও, আফসোসও করতে পারো একটুখানি। অবশ্য তোমরা লজ্জিত হতে পারো, একটু বিব্রত হতে পারো। কিন্তু আফসোস করতে পারো না। কারন আমরা জানি আবার যদি কখনো ৫২, ৬৯, ৭১, ৮৭ কিংবা ৯০ আসে 'নির্বুদ্ধি' তোমরা ঠিকই আসবে আমাদের প্রয়োজনে। এরকম ১০' নভেম্বরের মতো দিন গুলোতে তোমাদের জন্য লোক দেখানো কিছু মায়া কান্নার আয়োজন করতে হবে, কারন আমরা এক পক্ষ যেহেতু করবো আরেক পক্ষ এতটা নির্লজ্জ- অকৃতজ্ঞ হয়ে বসে থাকতে পারবো না।

তোমরা বিসর্জিত হবার জন্য সদা প্রস্তুত থাকো আমাদের মতো প্রভুর স্বার্থে। কিন্তু আমরা তোমাদের বিসর্জন দেইনা, খরচ করি। 'বিসর্জন' তো ত্যাগ, আর খরচ হচ্ছে লেনদেন। ও হ্যাঁ, তোমাকে যার কাছে খরচ করেছিলাম মানে তোমার যে খুনি, তাকে আমরা শত্রু গণ্য করিনা। সে তোমাকে না হয় একটু হত্যাই করলো, তাতে আমাদের কি? "