কিহোতের আংশিক সম্মোহন

নিরুপমা রহমান
Published : 5 Sept 2011, 06:16 PM
Updated : 20 March 2022, 03:33 PM


চিত্রকর্ম: সালবাদর দালি

মূল: হোর্হে লুইস বোর্হেস
অনুবাদ: নিরুপমা রহমান

অতীতে অগুনতিবার হয়তো এই বিষয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা হয়েছে কিন্তু তাতে নতুন করে এ বিষয়ে ভাবতে বা বলতে কোন বাঁধা আছে বলে আমি মনে করিনা।
অন্য নানান কালজয়ী সাহিত্য (ক্লাসিক) যেমন ইলিয়াড, এ্যানিড, ফারসালিয়া, দান্তের ডিভাইন কমেডি কিংবা শেক্সপিয়ারের ট্র্যাজেডি বা কমেডিসমূহের সাথে তুলনা সাপেক্ষে আমি 'কিহোতে'কে বাস্তববাদী সাহিত্যকর্ম বলেই গণ্য করবো। তবে এই বাস্তববাদিতা কিন্তু ঊনিশ শতকের প্রচলিত ধারা থেকে ভিন্নমাত্রার। জোসেফ কনরাড তাঁর লেখায় খুব সচেতনতার সাথেই আধিদৈবিক বা অতিপ্রাকৃত উপাদানসমুহকে এড়িয়ে গেছেন। তাঁর গদ্যে তিনি সহজ স্বাভাবিকতা বজায় রেখেছেন। আর সেই স্বাভাবিক, সাধারণত্বের মাঝেই বিস্ময় বা চমক লুকিয়ে রাখবার প্রয়াস করেছেন । যদিও আমি নিশ্চিত নই যে মিগেল দ্য সারভেন্তেসও এমন করেই ভেবেছিলেন কীনা, কিন্তু এ কথা আমি হলফ করে বলতে পারি যে 'কিহোতে' লেখবার সময় তিনি গতানুগতিক বাস্তববাদী গদ্যময়তার আদলকে গড়েছেন কাব্যিক রূপকল্পের মিশেলে। বাস্তববাদের ভেতর কাব্যময়তার খোঁজ পেয়েছিলেন বলেই জোসেফ কনরাড এবং হেনরী জেমস তাঁদের উপন্যাসে বাস্তববাদকে খুব সচেতনভাবে ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু সারভেন্তেস বাস্তববাদ আর কাব্যিক রূপকল্পের মাঝে বৈপরীত্য খুঁজে পেতেন। সেই ভাবনা থেকেই হয়তো কাস্টিয়ের ধূলিধুসর পথপ্রান্তর অথবা জীর্ণ মলিন পান্থশালার চাইতে আমাদিসের বিশাল বিস্তীর্ণ আবছায়া জনপদের প্রতি তাঁর দৃশ্যমান পক্ষপাত ছিল। কখনও মনে হতে পারে যেন ঔপন্যাসিক সারভেন্তেস তাঁর লেখার শব্দমালায় যেন নাগরিক জীবনের নানান উপাচারকে কৌতুক- পরিহাস করেছেন, এর বাস্তবতাকে বিদ্রূপ ছুঁড়ে দিয়েছেন। এখানে লক্ষণীয় বিষয় এই যে যদিও আমাদের জন্য সারভেন্তেস সপ্তদশ শতকের কবিতা সৃষ্টি করেছেন কিন্তু সেই সপ্তদশ শতকের সময় কিংবা সে সময়কার স্পেন কোনটির মাঝেই তিনি কোন কাব্যময়তা খুঁজে পাননি। আমার তো মনে হয় লা মাঞ্চার স্মৃতিচারণে উনামুনো কিংবা অ্যাজোরিন বা আন্টোনিও মাচাদো যে গভীর আবেগময়তায় আর বিহবলতায় ভেসেছিলো, তাও হয়তো সারভেন্তাসকে তেমন করে স্পর্শ করেনি, কিংবা তিনি তা তাঁর বোধগম্যতায় আনতেই চাননি। তাঁর সাহিত্যকর্মে তিনি একদিকে অ্তিলৌকিকতা্র চমৎকারিত্বকে পরিহার করেছেন। আবার অন্যদিকে গোয়েন্দা গল্পে যেমন অপরাধের অস্পষ্টতা আর রহস্যময়তার উন্মোচনের সংশ্লেষে এক ধরণের বিস্ময়ময়তা লুকিয়ে থাকে, তেমনি সচেতনভাবে অ্তিলৌকিকতা্র চমৎকারিত্বকে এড়ানোর মধ্য দিয়ে তাঁর লেখায় এক অনন্য বিস্ময়ময়তা তথা চমৎকারিত্বের ছাপ পরোক্ষ কিন্তু সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। সারভেন্তাস তাঁর লেখায় কোন মন্ত্রপূত জাদুকরী রহস্যময়তাকে আশ্রয় করেননি। অতিলৌকিকতাকে জাদুকরী রহস্যময়তায় না ঢেকে বরং খুব সুক্ষ কিন্তু নিগুঢ়ভাবে প্রয়োগ করেছেন। আর এতে এর প্রায়োগিক কার্যকারিতা বেড়েছে নিঃসন্দেহে। কার্যত অতিলৌকিকতাকে তিনি ধারণ করতেন তাঁর অন্তরের গভীরে। ১৯২৪ সালে পল গ্রুসাক তাঁর পর্যবেক্ষণে লিখেছেন 'লাতিন আর ইতালিয়ান ভাষায় যৎসামান্য তথা অপ্রতুল জ্ঞানের কারণে সারভেন্তাস তাঁর সাহিত্যের রসদ আর উপজীব্য নিয়েছেন লোকায়ত সাহিত্যের উপকরণ থেকে, মধ্যযুগীয় বীরব্রতের ব্যাখ্যান আর বীরত্বের আখ্যান তাকে তাঁর বন্দীত্বে স্বস্তি জুগিয়েছে, দিয়েছে প্রবোধ'। তাই এ কথা বললে মোটেও ভুল হবেনা যে 'কিহোতে' যত না ঐ সকল লোকায়ত আর মধ্যযুগীয় উপাখ্যানের একঘেয়েমী থেকে মুক্তির আশ্বাস দেয়, তার চেয়ে বেশি যেন সুযোগ করে দেয় এসব আখ্যানকে ঘিরে থাকা অতীতের স্মৃতিকাতরতাকে নীরবে চিরবিদায় জানাতে।


চিত্রকর্ম: সালবাদর দালি

বাস্তবিক অর্থে প্রতিটি উপন্যাসই কিন্তু বাস্তববাদের আদর্শ প্রতিমূর্তি। সারভেন্তাসের লেখায় খুব সহজাতভাবে বস্তুগত আর মনোগত জাগতিক ভাবনার মিশেল ঘটেছে। এই কাজ তিনি এমন সুচারুভাবে করতেন যাতে পাঠকের বাস্তব জগত আর বইয়ের ভেতরকার জগত মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। উপন্যাসের নানান অধ্যায়ে, যেমন ক্ষৌরকারের মাথা ঢাকবার সাধারণ পাত্রকে মুল্যবান শিরস্ত্রাণ বলে চালিয়ে দেবার ঘটনা বর্ণনায়, কিংবা ঘোড়ার জীন না কী তা ঘোড়ার সাজ এ নিয়ে ভ্রম হবার উল্লেখে বস্তুগত জগতকে খুব সুনির্দিষ্টভাবেই পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন সারভেন্তাস। আবার অন্যান্য নানান অধ্যায়ে অতোটা সুস্পষ্ট না থেকে পাঠককে হালকা ইঙ্গিত দেওয়াকেই যথেষ্ট বলে ভেবেছেন। ষষ্ট অধ্যায়ের প্রথম পর্বে যাজক আর ক্ষৌরকার মিলে যখন ডন কিহোটের গ্রন্থশালা ঘাঁটছেন, বেছে চলেছেন কোন বই রাখা হবে আর কোনটা নয়, তখন বেশ অবাকই হতে হয় যখন দেখা যায় এর মধ্যে একটি বই সারভেন্তাসের নিজেরই লেখা 'গ্যালাতিয়া'। কাহিনীতে প্রতীয়মান হয় যে ক্ষৌরকার সারভেন্তাসের বন্ধু হলেও তাঁর প্রতি ক্ষৌরকারের শ্রদ্ধাবোধ খুব বিশেষ ছিলোনা। তাঁর প্রজ্ঞা তথা জ্ঞানের গভীরতা নিয়েও ক্ষৌরকার এ পর্যায়ে এক প্রকার উপহাসই করে বলা চলে। ক্ষৌরকারের মতে 'গ্যালাতিয়া'তে সারভেন্তাস যে কাহিনীর রূপরেখা সাজিয়েছিলেন, তা মন্দ নয়, হয়তো নতুন কিছু ভাবনার সূত্রপাতও করেছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে কোন পূর্ণতার দিকেই নিয়ে যেতে পারেননি। এমনটি বলাই যায় নিজের সৃষ্ট চরিত্র এই ক্ষৌরকারের মারফত তথা উপন্যাসের এই অংশের চরিত্র আর তার সংলাপের বুননে সারভেন্তাস নিজেই তার নিজের সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন পাঠকের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছেন। আবার পাঠককে অবাক করে দিয়ে সারভেন্তাস নবম অধ্যায়ে জানান দেন সমগ্র 'কিহোতে' উপন্যাসখানাই না কী আরবী ভাষা থেকে গৃহীত যার পান্ডুলিপির খোঁজ তিনি পেয়েছিলেন টোলেডোর এক বাজারে। সারভেন্তাস নিজের বাড়িতে দেড় মাসের বেশি লম্বা সময় ধরে রেখে এক 'মরিস্কো' (আরবীয় মুসলমান বংশোদ্ভূত স্পেনীয় খৃস্টান)কে দিয়ে এই পান্ডুলিপির অনুবাদের কাজটি শেষ করিয়েছিলেন। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের মনে পড়ে টমাস কার্লাইলের 'সারটর রেসারটাস' উপন্যাসের কথা যা কীনা জার্মান অধ্যাপক ডঃ ডিওগেনাস টয়ফেলসডাখের আত্মচিন্তা আর ভাবনার আখ্যান বলে কার্লাইল উল্লেখ করেছেন। আবার এ প্রসঙ্গেই উল্লেখ করা চলে স্পেনীয় ইহুদী পাদ্রী মৌসেস দে লিওনের 'যোহার' এর নাম, যা পড়লে মনে হবে এ যেন তৃতীয় শতাব্দীতে কোন এক প্যালেস্তানীয় পাদ্রীর ভাবনা আর দর্শনের অনুলেখন কিংবা পুনঃকথন।

দ্বিতীয় পর্বে এসে বেশ কিছু চমকপ্রদ বৈপরীত্য পরিণতির দিকে যেতে থাকে। 'কিহোতে'র মূল চরিত্র বস্তুত পক্ষে আমরা, এর পাঠকেরাই। আর মূখ্য সেই চরিত্র পাঠক কিন্তু প্রথম পর্ব পড়েই দ্বিতীয় পর্বে পৌঁছুতে পেরেছেন। এখানে খুব স্বাভাবিক ভাবেই মনে পড়ে শেক্সপীয়ারকে যিনি মঞ্চে হ্যামলেটের সামনেই আরেক হ্যামলেটকে তুলে ধরেন। লেখকের সৃষ্ট মূল চরিত্র হ্যামলেট আর লেখকের মনোগত হ্যামলেট ট্র্যাজেডিতে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়, এখানে হ্যামলেটই হ্যামলেটের দর্শক। এই ঘটমান দৃশ্যমান অনুরূপ চরিত্রের সমান্তরাল সংযুক্তিতে প্রাথমিক সৃষ্টি আর সেই সৃষ্টির ভেতরকার সৃষ্টির তারতম্যের গণ্ডি বিলীন হয়ে আসতে থাকে। সারভেন্তাসের এমনতর ভাবনার সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায় বাল্মিকীর মহাকাব্য 'রামায়ণে'র যেখানে রাম আর অসুরের সাথে রামের যুদ্ধের আখ্যান বর্ণিত হয়েছে। রামায়ণের শেষ অধ্যায়ে দেখা যায় পিতৃপরিচয় অজ্ঞাত রামের সন্তানেরা অরণ্যে তপস্বীর কাছে শিক্ষালাভ করছে। সেই তপস্বী আর কেউ নয়, স্বয়ং ঋষি বাল্মিকী আর চমকপ্রদভাবে তারা বাল্মিকীর কাছে রামায়ণই পড়ছে। এর পরবর্তী দৃশ্যে রাম অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেন আর সেখানে ঋষি বাল্মিকী তাঁর শিষ্যদের নিয়ে যোগদান করেন। সেই শিষ্যরা বীণা বাজিয়ে রামায়ণ গেয়ে শোনালে রাম নিজের আখ্যানের বিস্তারিত জানতে পারেন, অজানা অচেনা পুত্রদ্বয়কে চিনে বুকে টেনে নেন আর পুরস্কৃত করেন কবি বাল্মিকীকে।


চিত্রকর্ম: সালবাদর দালি

অনুরূপ চিত্রণ পাওয়া যায় 'সহস্র এক আরব্য রজনী'র কাহিনীতেও। এখানেও কাহিনীর ভেতরে কাহিনীর পর কাহিনী সাজিয়ে এমন ঘূর্ণাবর্ত তৈরি করা হয়েছে যাতে মূল কাহিনীর চূড়ান্ত গভীর বাস্তব পরিণতির চেয়ে প্রতিমুহূর্তে ঘটমান গল্পের পরিণতি পাঠককে উৎসুক করে তোলে। আবার এও ঠিক এই সমস্তটাই ঘুরেফিরে মূল কাহিনীর পরিণতির দিকে এগিয়ে নেয় পাঠককে হয়তো তার অগোচরেই। মূল কাহিনীর সূত্রপাতটা সকলেরই জানা। সেই দুরন্ত প্রতাপশালী সুলতান আর তার সেই ভয়ঙ্কর প্রতিজ্ঞার গল্প। প্রতিরাতে একজন কুমারী মেয়েকে বিয়ে করে, রাত ভোর না হতেই জল্লাদকে তার শিরোচ্ছেদের নির্দেশের অনড় প্রতিজ্ঞা ছিল সুলতানের। এমন সময় কাহিনীতে প্রবেশ ঘটে সাহসী, প্রত্যুৎপন্নমতি শেহেরজাদীর। সপ্রতিভ শেহেরজাদী সুলতানকে বিয়ে করে এক হাজার এক রাত ধরে কাহিনীর সুতোয় কাহিনী গেঁথে সুলতানের মন এমনই মজিয়ে রেখেছিলেন যে শুরু হওয়া কাহিনীর পরিণতি জানবার ঔৎসুক্য তাকে শেহেরজাদীকে ভোরবেলাতে জল্লাদের হাতে তুলে দেওয়া থেকে বিরত রাখতো। সহস্র এক রজনীর পর গল্পের ঘূর্ণাবর্ত যতদিনে ফুরোল, ততদিনে শেহেরজাদীর কোল আলো করে এসেছে সুলতানের পুত্র। এই কাহিনীগাথার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, অনন্য বিস্ময় হলো এক কাহিনীর সাথে অন্য কাহিনীর নিরন্তর সংযোজন তথা এক আখ্যানের ভেতর অন্য আখ্যানের অন্তঃপ্রবেশ। এর মাঝে সবচেয়ে চমকপ্রদ আখ্যানের সূত্রপাত ঘটে ৬০২তম রাতে। এই কাহিনীর সূচনা এ রাতকে অনন্য করে তুলেছে এই গ্রন্থে। এই কাহিনীতেই শেহেরজাদীর মুখে সুলতান নিজের আখ্যান শুনতে শুরু করেন, এখানে যেমন মূল কাহিনীর সূত্রপাতের ঘটনার উল্লেখ আছে তেমন করে বাকি সব গল্পও কাহিনীর ঘূর্ণাবর্তের কেন্দ্রে ফিরে আসতে থাকে। পাঠক কী আদৌ বুঝতে পারে যে কাহিনীর ভেতর কাহিনীর নিরন্তর সংযোজন অন্তঃপ্রবেশের দুর্নিবার ঘূর্ণাবর্তে সে ক্রমাগত আটকা পড়তে যাচ্ছে? শেষ পর্যন্ত ঔৎসুক্যের ঘেরাটোপে পড়ে সুলতানের মতো আমরা পাঠকেরাও অনিঃশেষ এক কাহিনীর ঘূর্ণায়মান চক্রে আটকা পড়ে যাবো?

দর্শনের উদ্ভাবন শিল্পকলার সৃজনের চেয়ে কোন অংশে কম বিস্ময়কর নয়। যোসিয়া রয়েস তাঁর 'দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যান্ড দ্য ইন্ডিভিজুয়াল' বইয়ের প্রথম খন্ডে লিখেছেন
'ধরা যাক, ইংল্যান্ডের এক অংশের ভূমিকে একেবার সুচারুরূপে সমতল আর মসৃণ করে নেওয়া হলো, তারপর সেই অংশটাকে এমতাবস্থায় রেখে ইংল্যান্ডের মানচিত্র আমরা মনে মনে কল্পনা করতে চাইলাম… কিন্তু ধরা যাক সেই প্রতিচ্ছবিকে মূল সঠিক মানচিত্রের সাথে হুবহু মেলাতে হবে। নতুন করে ভাবা সেই ইংল্যান্ডের মানচিত্রে আবার মুল মানচিত্রে দেখানো প্রতিটি নির্দেশক সমুন্নতি রেখা, প্রতিটি ভৌগলিক চিহ্ন, প্রাকৃতিক কিংবা অপ্রাকৃতিক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকেও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে রাখতে হবে। এই নতুন মানচিত্রকে সম্পূর্ণতা দিতে নিয়ম অনুযায়ী আবার নতুন করে কল্পিত ভুমিরূপ, তার নির্দেশক সমুন্নতি রেখা, প্রতিটি ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক চিহ্নসকলও রাখতে হবে। আর এই কাজ নিশ্চিত করতে মূল প্রতিকৃতিতে প্রতিরূপের আদল সংযোজন করে তাকে মূলের কাছে নিয়ে তার আদলের অনুঃপ্রবেশ করাতে হবে নতুন প্রতিমূর্তি গড়তে; একেবারে সঠিক প্রতিচ্ছবি গড়তে আবারও একবার প্রতিরূপ গড়তে হবে। আর অনিঃশেষ এই প্রক্রিয়া চক্রাকারে চলতেই থাকবে।'

মানচিত্রের ভেতর মানচিত্রের এই ভাবনায় আমরা কেন অস্বছন্দ বোধ করি? কেন আমরা উৎকলিত হই, উদ্বেলিত হই এই জেনে যে সহস্র একটি রাত আছে 'সহস্র এক আরব্য রজনী' গ্রন্থে? কেন আমরা এটা জেনে ভাবিত হই, চঞ্চল হই যে ডন কিহোতে বস্তুত 'কিহোতে'র পাঠক, আর হ্যামলেট প্রকৃতপক্ষে হ্যামলেটের দর্শক? আমি বিশ্বাস করি আমি আসলে এর উত্তর খুঁজে পেয়েছি : এই সমস্ত কিছুই একটা নির্দেশনাই দেয় আর তা হলো এসকল আখ্যানের চরিত্ররা যদি পাঠক বা দর্শক হতে পারে, তবে আমরা পাঠকেরা কিংবা দর্শকেরাও অনুমিত বা কল্পিত হতে পারি। ১৮৩৩ সালে কার্লাইল বলেছিলেন এই ব্রহ্মান্ডের ইতিহাস এক অনিঃশেষ চিরচলমান পবিত্র গ্রন্থ। একদিকে আমরা প্রতিটি মানুষ যেমন এই গ্রন্থের লেখক, পাঠক; আবার মনে রাখতে হবে, আমরাই এর বিষয়বস্তু।