রোহিঙ্গা ইস্যুতে পিণাকের উস্মা ও কূটনীতির ভাষা

স্বদেশ রায়
Published : 22 Nov 2011, 02:22 AM
Updated : 11 Oct 2017, 03:52 AM

কূটনীতিক হিসেবে পিণাক রঞ্জন চক্রবর্তী ঢাকায় দায়িত্ব পালনকালে তাঁর পক্ষে সফল কূটনীতিক হওয়া বেশ কঠিন ছিল। বাংলাদেশে এ অব্দি অনেক সফল ভারতীয় কূটনীতিক কাজ করে গেছেন। তাদের কেউ কেউ এখনও চাকুরিতে আছেন। তাই সবার নাম উল্লেখ করার সময় আসেনি।

যাহোক, পিণাক অর্থ শিব। শিব যেমন সত্য ও সুন্দরের প্রতীক তেমনি একটু বদমেজাজেরও। সম্প্রতি বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সমস্যা বা মিয়ানমার-বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে পিণাক বিবিসি বাংলাকে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, সেখানে তাঁর ভাষার মধ্যে একটু তাচ্ছিল্য ও ক্রোধ প্রকাশ পেয়েছে। কেন তিনি এমনটি করলেন ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তাঁর মানের একজন সিনিয়র কূটনীতিক যে কূটনৈতিক টেম্পারমেন্ট হারাবেন এমনটি ভাবা যায় না। ভাবা সঠিক নয়। তারপরেও মি. পিণাকের এ ভাষা ব্যবহার একটু হলেও ভাবিয়ে তোলে। তিনি বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাতকারে বলেন:

"চায়না ওদের (বাংলাদেশের) বিশেষ বন্ধু হয়েছে এখন। চায়নাকে জিজ্ঞেস করুক। ওরা কিছু করুক… কিছু রোহিঙ্গা চায়না নিয়ে নিক না।"

কুটনীতি ও রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রু মিত্র নেই। তবে কুটনীতির ক্ষেত্রে একটি বিষয় সব সময় ভিন্ন; সেটা হল প্রতিবেশি। প্রতিবেশি যেহেতু প্রতিদিনের সাথী, তাই তার সঙ্গে কূটনীতি করতে হয় সরলরেখায়। ভারত ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ রেখা ১৯৭৫এর পনের আগস্টের পর বেশ বাঁকা হয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে দুই দেশের কূটনীতি যখন বন্ধুত্বের আবহাওয়ায় চলছে সে সময় পিণাকের মতো একজন সিনিয়র কূটনীতিকের এ ভাষায় কথা বলা মানায় না। যেমন পিণাক বলেছেন, 'চায়না এখন ওদের বন্ধু হয়েছে'– এ কথার মধ্যে একটি সূচালো খোঁচা রয়েছে। মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ অব্দি চীন যে আমাদের বন্ধু ছিল না সে কথা।

মি. পিণাকেরই ভালো জানার কথা যে, ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পর থেকে 'চীন-হিন্দ ভাই ভাই' সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। তখনও চলছে জওহরলাল নেহরুর জমানা। আবার ১৯৮০এর দশকে এসে চায়নায় পা রাখেন নেহরু পরিবারের উত্তরাধিকার, প্রযুক্তির ভারতের নির্মাতা রাজীব গান্ধী। নেহেরুর দৌহিত্র রাজীবের আমলে যখন চীন-ভারত বন্ধুত্বের দুয়ার খোলে তখন কোনো কূটনীতিক বা রাজনৈতিক বিশ্লেষক এই বলে সুচালো খোঁচা দেননি যে, 'ভারত এখন চায়নার বন্ধু হয়েছে'।

বরং কেউ কেউ সন্দেহ পোষণ করেছিলেন যে, এ বন্ধুত্ব স্থায়ী রূপ নেবে না। আবার অনেকের ধারণা ছিল যে, এশিয়ার এই দুটি উদীয়মান অর্থনীতির মধ্যে যদি বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকে তাহলে দ্রুতই পশ্চিমা বিশ্ব থেকে অর্থনীতি পূবের দিকে চলে আসবে। অনেকে আলোচনা করেছেন পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের যে বন্ধুত্ব তার ফলে ভারত-চীনের মধ্যে স্থায়ী সম্পর্ক সম্ভব না-ও হতে পারে।

বাস্তবতা হচ্ছে, কখনও কিছু কিছু বিষয় প্রতিকূলে যাচ্ছে, বাকি সব থাকছে অনুকূলে। তারপরও ভারত-চীনের বন্ধুত্বে ছেদ পড়ছে না। এমনকি ডোকলামের পরও তাদের বন্ধুত্ব অটুট রয়ে গেছে। আবার চীনের ওয়ান-ব্লেট-ওয়ান রোড নীতির পরও দেশ দুটির কূটনৈতিক যোগাযোগ এগিয়ে চলেছে।

সে সব বিচার করে বলতে হয়, বর্তমানে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বন্ধুত্ব হয়েছে তা বিশ্বরাজনীতিতে নতুন কিছু নয়। ভারত ও বাংলাদেশের বন্ধুত্বের সঙ্গে যেমন চীন-ভারত মিত্রতার ধরন মিলবে না, তেমনি চীন-বাংলাদেশের যোগাযোগের সঙ্গেও নয়। কারণটা অতি সহজ। নিকটতম প্রতিবেশির সঙ্গে সব সময় ভিন্ন ধরনের সম্পর্ক তৈরি হয়। সেখানে শত্রুতা হলে লোকসান।

যেমন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চিরস্থায়ী শত্রুতায় দুদেশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, হচ্ছে। পাকিস্তানি রাজনীতিবিদরাও এ সত্য উপলব্ধি করেন। তারপরও সন্ত্রাসবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের কাছে তারা এতটাই বাধা পড়েছেন যে, তাদের কিছুই করার নেই। এমনকি পাকিস্তানে কোনো রাজনীতিক যদি ডায়নামিক হয়ে ওঠেন তাকে প্রাণ দিতে হয়, না হয় ক্ষমতা ছাড়তে হয়। এর জ্বলন্ত উদাহরণ প্রয়াত বেনজীর ভুট্টো ও সদ্যক্ষমতাচ্যুত নওয়াজ শরীফ।

তারপরও কূটনীতির এ খেলায় মাথা গরম করার কোনো স্থান নেই। এখানে উস্মা দেখানোরও সুযোগ অনুপস্থিত। বাংলাদেশে মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে রোহিঙ্গারা শরণার্থী হিসেবে এসেছেন। তবে এত বড় ঘটনার পরও মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি, এমনকি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কোনো বাধা তৈরি হবে না। চিরশত্রু ভারত-পাকিস্তানের মধ্যেও এমন ঘটনার উদাহরণ রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যখন কারগিল নিয়ে যুদ্ধ চলছিল সে সময়ও পাকিস্তান তাদের নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা ভারতের কাছ থেকে পেয়েছে। তাই রোহিঙ্গা ইস্যুর পরও মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে ছেদ পড়বে না।

তবে তাই বলে মিয়নামারের সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ইস্যুতে বাংলাদেশ একা লড়বে না। কূটনীতিক তৎপরতাও এভাবে চালাবে না। এখানে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোকে যেমন সঙ্গে নেব আমরা তেমনি মিয়ানমার ও আরেক প্রতিবেশি হিসেবে ভারতকেও সংযুক্ত করতে চাইব। কূটনীতিকভাবে বাংলাদেশ যদি সফল হয় তখন ভারত অবশ্যই বাংলাদেশের সঙ্গে থাকবে। মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের ভালো সম্পর্ক বলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত একদম গোঁড়াভাবে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে এমন চিন্তা কূটনৈতিক শাস্ত্রে নেই।

অন্যদিকে, এক দেশের মানুষ নির্যাতিত হয়ে, প্রাণভয়ে পালিয়ে অন্য দেশে চলে গেলে তাদেরকে সবাই মিলে ভাগ করে নিবে এমন কোনো নীতি আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নেই। যদি আগেকার সেই দাস বিক্রির যুগ থাকত তাহলে অসহায় মানুষদের সস্তা শ্রমিক হিসেবে নানা দেশ ভাগ করে নিত। বর্তমান পৃথিবী মানবতার পৃথিবী। এখানে 'চায়না কিছু নিয়ে নিক' জাতীয় অকূটনৈতিক, উস্মা-প্রকাশক বাক্যচয়নের বাস্তবতা নেই।

রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অবস্থান নিলে জঙ্গিবাদের পালে হাওয়া লাগবে এমন আশঙ্কারও বাস্তব ভিত্তি নেই। বাংলাদেশ তার সীমানার ভেতরের জঙ্গিদের দমন করতে পারছে সফলভাবে। আর দশ লাখ রোহিঙ্গার যে কজন জঙ্গি হবে বা জঙ্গিবাদী রাজনীতিতে যুক্ত হবে (যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই যে, মিয়ানমার ওদের ফেরত নিচ্ছে না এবং আমাদেরকেই ওদের পালতে হচ্ছে, তাহলে আর কী) তেমন দুষ্টের দমন কঠিন হবে না।

পশ্চিমা কিছু সাংবাদিক শুধু নয়, এশিয়ার অনান্য দেশেরও অনেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি শেখ হাসিনার ধর্মীয় রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়া হিসেবে দেখছেন। তারা যে ভুল করছেন তা হল, তারা রোহিঙ্গাদের মুসলিম হিসেবেই দেখছেন, বিপন্ন মানুষ হিসেবে নয়। সেভাবে দেখলে বরং বলা যায়, শেখ হাসিনা মানবিকতার রাজনীতি করছেন– মহাত্মা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু যে ধারার রাজনীতি করেছিলেন– বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে যে বিশ্বমানবতার আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন– সে সবই শেখ হাসিনার সম্পদ। এই দশ লাখ মানুষের দায় তিনি নিজের দরিদ্র দেশের ওপর চাপিয়েছেন। তাই এখানে ক্ষুব্ধ যদি হতে হয় তবে বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষের হওয়া উচিত– অন্য কোনো দেশের কোনো কূটনীতিকের নয়।

পশ্চিমা সাংবাদিক ও এশীয় কূটনীতিকদের অনেকে একটি সত্য বুঝতে মনে হয় ভুল করছেন। শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সমস্যাটি কাঁধে নিয়ে দীর্ঘদিনের একটি মানবিক বিপর্যয়ের সমাধানের জন্য আলোচনা ও পদক্ষেপের দরজা খুলে দিয়েছেন। পথটি পেরুতে বেশ সময় লাগবে। শেখ হাসিনার নিজের দেশের মানুষদের এ জন্য কিছু মূল্য দিতে হবে। পাঁচ দশকের বেশি সময়ের পুরনো একটি জাতিগত সমস্যা এবারই প্রথম বিশ্বসভায় নিয়ে গেছেন তিনি। তাই জটিলতম এ সমস্যার সমাধানে সময় তো লাগবেই।

পরোক্ষভাবে হলেও মি. পিণাক একটি বিষয়ে একমত। তিনি বলেছেন, আর্ন্তজাতিকভাবে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হবে। সেখানে তিনি চীন ও রাশিয়ার নাম উল্লেখ করেছেন। বাস্তবে শুধু চীন ও রাশিয়া নয়, আসিয়ানভুক্ত সকল দেশ এবং পশ্চিমা বিশ্বকে এক করেই সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।

সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ থেকে মুক্ত রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাক। সেখানে তারা ফিরে পাক নাগরিকত্ব। শত নৃগোষ্ঠীর দেশ মিয়ানমার ধীরে ধীরে একটি বহুত্ববাদী দেশে পরিণত হোক। যেখানে মেজরিটির সঙ্গে মাইনরিটি একই সমান্তরালে বাস করতে পারবে। শেখ হাসিনা সেই প্রত্যাশা থেকেই এগুচ্ছেন এখন।

রাজনীতিবিদরা নিঃসন্দেহে স্বপ্ন দেখেন, আবার তার বাস্তবায়ন করেন। অন্যদিকে, কূটনীতিকরা তাদের দায়িত্ব পালন করেন রাজনীতিবিদদের অধীনে। কখনও কখনও দেখা যায় প্রাক্তন কূটনীতিকরা রাজনীতিকদের অনেক জ্ঞানও দিচ্ছেন। তবে কূটনীতিবিদদের মধ্যেও অনেকে রাজনীতিবিদদের মতো মহৎ দায়িত্ব পালণ করে বিশ্বকে উপকৃত করেছেন।

তেমন সুযোগ পেলে পিণাক রঞ্জনরা তা করে দেখাতে পারেন। সেটি না করে কূটনীতির সব বিষয় জেনেও নিস্ফল উস্মা দেখিয়ে তিনি বিশেষ কিছু ফায়দা করতে পারবেন না। না ভারতের জন্য, না বাংলাদেশের, না রোহিঙ্গাদের।