আমার শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ক পোস্ট এ সম্প্রতি সম্মানিত ব্লগার সৈয়দ রিয়াজ মন্তব্যের ঘরে লিখেছিলেন যে, আমরা যখন শিশুর পুষ্টি নিয়ে কথা বলছি তখন কীটনাশক দেয়া লিচু খেয়ে দিনাজপুরের ১৪ জন শিশু মারা গেছে। যাদের বয়স ছিল ২-৬ বছরের মধ্যে। পুষ্টি তো দূরের কথা নিরাপদ খাবারও আমরা শিশুদের জন্য নিশ্চিত করতে পারছি না। তারপর গতকাল আমার অতি প্রিয় ব্লগার পাগল মন এর খাদ্যের ভেজাল এর শিকার কোলন ক্যান্সার এ আক্রান্ত তার বোনের মৃত্যু সম্পর্কিত মর্মস্পর্শী পোস্টটি পড়লাম। সচেতন কিন্তু অক্ষম ব্লগার হিসেবে তাই কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করছি।
আজকের পত্রিকাতে দেখলাম পুরোনো সেই খবর কিছুটা নতুন ভাবে, যা দেখে আসছি দীর্ঘদিন থেকে। পুরোনো খবর হল আম পাকানো ও পচন রোধে ক্ষতিকর ক্যালসিয়াম কার্বাইড ও ফরমালিন মেশানো হচ্ছে। আর নতুন খবর হল এর সাথে নাকি আরো হাই পাওয়ার বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে। শুধু আম নয়,যেকোনো সবজি, মাছ, দুধ, বিদেশ হতে আমদানি করা যেকোনো ফল ছাড়াও সব খাবারেই মেশানো হচ্ছে কেমিক্যাল। এইসব কেমিক্যাল দেয়া খাদ্য নাকি সপ্তাহের পর সপ্তাহ ঘরে ফেলে রাখলে পচন ধরে না, নষ্ট হয় না। তাই পচনশীল খাদ্য টাটকা রাখতে এবং দীর্ঘদিন সংরক্ষণের জন্য মেশানো হচ্ছে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এইসব ক্যামিকাল ও ফরমালিন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব কেমিক্যালের কারণে মানুষের কিডনি ও ব্রেন নষ্ট হওয়া, লিভার ক্যান্সার, ব্লাড ক্যান্সারসহ মরণঘাতী রোগ ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত গতিতে। ভেজাল খাদ্য খেয়ে গর্ভবতী মায়ের সন্তান হতে পারে বিকলাঙ্গ। বর্তমানে বাংলাদেশে কিডনি রোগী ২ কোটি ২০ লাখ আর ক্যান্সারে আক্রান্ত প্রায় এক কোটি মানুষ যার জন্য নাকি খাদ্যে মিশানো বিষ অনেকাংশে দায়ী। বিষের এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে আর কিছুদিন পর ঘরে ঘরে এসব রোগে আক্রান্ত আমরা বা আমদের প্রিয়জন মৃত্যুর প্রহর গুনবো।
কিন্তু কথা হচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল ও অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ থেকে মুক্ত খাদ্য বাজারজাত ও বিক্রি করার জন্য দেশে কি কোন আইন নেই? আর আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ কী হচ্ছে?
পাঠক, সুখের কথা আমাদের দেশে খাদ্যে ভেজাল রোধে আইন আছে। ১৯৫৯ সালের বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ আইনে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিজে বা অপরের মাধ্যমে এমন কোন বিষাক্ত বা ক্ষতিকর কেমিক্যাল বা উপাদান যেমন রঞ্জকদ্রব্য বা ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ফরমালিন ও কীটনাশকের মতো এমন কোন পদার্থ বা স্বাদ্গন্ধযুক্ত কোন দ্রব্য খাদ্যে মেশাবেন না যা মানবদেহের ক্ষতি সাধন করতে পারে এবং এই সব ক্যামিকেল মিশ্রিত এমন কোন খাদ্য বিক্রি করবেন না। আর যদি তা করে থাকে অর্থাত্ এই আইন ভঙ্গ করলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পাঁচ হাজার টাকা হতে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা এবং ছয় মাস হতে তিন বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা যাবে।
এরপর ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ (গ) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনও ব্যাক্তি কোন খাদ্য বা পানীয় দ্রব্যে ভেজাল দিয়ে তা ভক্ষণ বা পান করার অযোগ্য করে ও তা খাদ্য, পানীয় হিসেবে বিক্রি করতে চায়, অথবা তা খাদ্য বা পানীয় হিসেবে বিক্রি হবে জানা সত্ত্বেও অনুরূপ ভেজাল দেয়; অথবা কোনো দ্রব্য নষ্ট হয়েছে বা নষ্ট করা হয়েছে বা খাদ্য, পানীয় হিসেবে অযোগ্য হয়েছে জানা সত্ত্বেও অনুরূপ কোনো দ্রব্য বিক্রি করে বা বিক্রির জন্য উপস্থিত করে, তবে সে অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা চৌদ্দ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড ও জরিমানাদণ্ড উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবে।
এছাড়াও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কেমিক্যাল ফলমূলে মেশানো বন্ধ করতে ২০১১ সালের ২৬ মে এবং ২০১২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি ২টি পৃথক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সরকারকে জরুরী নির্দেশাবলীর প্রদান করে। এ নির্দেশাবলীর মধ্যে ছিল
i. ফলের বাজার ও আড়তের ওপর বিএসটিআই ও আইন-শৃংখলা বাহিনীর কড়া নজরদারি এবং দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ; ii. ফলমূলে রাসায়নিক দ্রব্যাদি মেশানো বন্ধের উপায় নির্ধারণের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক সুপারিশ প্রদান; iii. কেমিক্যাল মেশানো ফল যেন দেশের স্থল ও নৌ বন্দরগুলো দিয়ে প্রবেশ করতে না পারে এবং আমদানিকৃত ফল কেমিক্যাল মেশানো কিনা তা পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে নির্দেশ প্রদান; iv. ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যাদি মেশানো ফল বিক্রি বন্ধ; v. ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যাদি মেশানো ফল আমদানি ও বিক্রির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীনে মামলা দায়ের করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ প্রদান; vi. ফল পাকানো ও সংরক্ষণে কেমিক্যালের ব্যবহার অবৈধ ঘোষণা এবং দূষিত ফল যেন কেউ গুদামজাত ও বিক্রি করতে না পারে তা সর্বদা মনিটর করার জন্য বিএসটিআই ও আইন-শৃংখলা বাহিনীকে নির্দেশ প্রদান।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এত এত সুন্দর সুন্দর আইন এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও খাদ্যে বিষ মেশানো বন্ধ হচ্ছেনা কেন?
বিষ মেশানো বন্ধ হচ্ছে না কারণ আমরা জাতি হিসেবে পচে গেছি। অতি মুনাফার লোভে আমাদের অসাধু ব্যবসায়ীরা এই জঘন্য কাজ করছে।আমাদের রাজনৈতিক নেতারা দেখেও না দেখার ভান করছে। কারণ খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণের জন্য দায়ী টাকার কুমির রাঘববোয়ালেরা ধরা ছোয়ার অনেক বাইরে অবস্থান করে। ধারনা করে নিতে কষ্ট হয় না যে এদের আছে রাজনৈতিক প্রভাব। হয়তো অনেকেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দলের সক্রিয় সদস্য কিংবা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে রয়েছে তাদের দহরম মহরম সম্পর্ক। কখনো পত্রিকায় লেখালেখি হলে মাঝে মাঝে ভ্রাম্যমাণ আদালত চুনোপুঁটি খুচরো বিক্রেতার বিরুদ্ধে মামলা দেন। কিছু দোকান পাটকে জরিমানা করেন। টেলিভিশনে তা দেখে আমরা তৃপ্ত হই। পরদিন সব ভুলে গিয়ে ক্ষতিকর কেমিক্যাল মেশানো জেনেও এসব খাবার আমরা আমাদের প্রিয়জনদের জন্য কিনে আনি। রসনা তৃপ্ত করি রসালো বিষে টইটুম্বর খাদ্য দিয়ে।
এখন আপনি বলতে পারেন, জেনেশুনে কেন আমরা বিষ কিনছি?? বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো ফলমূল না কিনলেই তো ব্যবসায়ীরা এসব ফলে কেমিক্যাল মেশাতে এবং বিক্রিতে নিরুত্সাহিত হবে। কিন্তু এটাই কী সমাধান? পচনশীল সমাজের পচে যাওয়া খাবার না খেলে যে অতি জনবহুল এই দেশটার জনসংখা কমবে না!!! তাইতো দেশ বাচাতে এই বিষ ভক্ষণ পলিসি গ্রহণ। আর বিষ খেয়ে তিল তিল করে মরে যাওয়া আমরা ভুক্তভুগীরা চিত্কার করে উঠি ওই ব্যবসায়ীদের ক্রসফায়ারে দাও। এ বিষ থেকে বাচার কোনও পথ যে আমাদের সামনে খোলা নাই। দুর্নীতি আর অনিয়মের কারণে যে বিষ ছড়িয়ে পড়ছে মহামারির মত, তা যেন আমাদের এই পচনশীল সমাজের ই প্রতিচ্ছবি।