বাতাসে লাশের গন্ধ আর আমাদের পোশাক শিল্প

জিনিয়া
Published : 26 Nov 2012, 06:01 AM
Updated : 26 Nov 2012, 06:01 AM

আমাদের পোশাক শিল্পে দগ্ধ লাশ মোটেও নতুন কোনও খবর নয়। পরিসংখ্যানে দেখতে পাই, গড়ে বছরে এক থেকে দেড়শ জন পোশাকশ্রমিক আগুনে পুড়ে মারা যান। এই তো গত ২৫ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের গরীব অ্যান্ড গরীব পোশাক কারখানায় আগুনে পুড়ে মারা গেছেন ২১ জন শ্রমিক। মাস পেরিয়ে আবারও বাতাসে লাশের গন্ধ!!! অথচ চলুন একটু ফিরে দেখা যাক এই দগ্ধ লাশগুলো আমাদের দেশের অর্থনীতিকে কিভাবে জীবন্ত আর আনন্দময় করে তুলেছিলেন প্রতিনিয়ত।

সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণালব্ধ রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নের অগ্রগতিতে যে তিনটি খাত মূল অবদান রেখে চলেছে, তা হল কৃষি, তৈরি পোশাক শিল্প ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। এর মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্প দেশের প্রধান রপ্তানি খাত হিসেবে বিবেচিত।রপ্তানি আয় এর ৭৫ শতাংশের বেশি আসে এই একটি খাত থেকে। বেকার সমস্যা সমাধানেও এই খাত অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছে। এ খাতে দেশের মোট ৩৫ লক্ষ শ্রমজীবী নিয়োজিত যার মধ্যে ২৭ লক্ষ নারী শ্রমিক রয়েছেন।

৩০ বছর ধরে গড়ে ওঠা এই তৈরি পোশাক শিল্প আজ আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির অংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ডব্লিউটিও এর 'ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড স্ট্যাটিসটিকস-২০১২' দলিল থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে বিশ্ব বাজারে আমাদের পোশাক শিল্প অংশ বেড়ে হয়েছে ৪.৮ যা কী না ২০০৯ সালে ছিল ৩.৪ শতাংশ। বিশ্বে পোশাক রপ্তানিকারক শীর্ষ ১৫ দেশ এর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান আজ তৃতীয়। ডব্লিউটিওর পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১১-১২ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি ডলার।

তো এই হচ্ছে পরিংখ্যানের উপাত্ত অনুসারে বাংলাদেশের অর্থিনীতিতে পোশাক শিল্পের ভূমিকা। বলাই বাহুল্য যে, আমাদের অর্থনীতির অগ্রগতির পিছনে রয়েছে আমাদের পোশাক শিল্পের কারিগরদের সস্তা শ্রম..মাসে মাত্র তিন হাজার টাকা দিয়েই কিনে নেয়া যায় একজন পোশাক শ্রমিকের দিবা-রাত্র। অনেক প্রতিকুল পরিবেশের মধ্যদিয়ে এই শ্রমিকেরা রক্তঘাম মেশানো শ্রম দিয়ে এদেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখছে। এ তো আমরা সবাই জানি যে, পোশাকশ্রমিকেরা পর্যাপ্ত মজুরি পান না। মজুরির কথা না হয় আজ বাদই দিলাম.. কর্মক্ষেত্রে জীবনের ন্যূনতম নিরাপত্তাও যে তাদের নেই।

দেশে প্রায় পাঁচ হাজার পোশাক কারখানার অধিকাংশগুলোতে নেই নিজস্ব অগ্নি নির্বাপণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পোশাক কারখানায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিভিন্ন নিয়মাবলী রয়েছে। এদের মধ্যে প্রয়োজনীয় শর্তগুলি হল, সব কারখানার ছাদ সম্পূর্ণ খোলা রাখা, নিচ থেকে ছাদে ওঠার ব্যবস্থা রাখা, ছাদে ওঠার দরজা সার্বক্ষণিক খোলা রাখা, কারখানার ভেতরে যাতায়াতের পথ, বিকল্প সিঁড়ি ও জরুরি গেট খোলা রাখা , দুটি মেশিনের মাঝখানে চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত দূরত্ব বজায় রাখা, কারখানার ফ্লোরে কাপড়সহ সব ধরনের দাহ্যসামগ্রী বড় লটে স্তূপ করা যাবে না, শর্টসার্কিট এড়ানোর জন্য কারখানাগুলো নিয়মিত নিজেদের পানি, সুয়্যারেজ লাইন ও বৈদ্যুতিক লাইন পরীক্ষা করা, কারখানাগুলোকে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করে শ্রমিকদের নিয়ে নিয়মিত মহড়া চালাতে হবে। এছাড়াও যতক্ষণ কারখানা চালু থাকবে, ততক্ষণ কারখানার অগ্নি মহড়া কর্মীরা ফ্লোরে টহল দেবেন। কিন্তু আদৌ কী এই সব শর্ত মেনে আমাদের পোশাক কারখানগুলো পরিচালিত হয় কী না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

যখনই কোনও দুর্ঘটনা ঘটে, নিয়ম মাফিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের পর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনগুলোতে একটি বিষয় জানা গেছে যে, অগ্নিকান্ডের সময় সিড়ির মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়। আগুন লাগার সাথে সাথে সামান্য কিছু অর্থ বাঁচানোর জন্য মালিকপক্ষ থেকে সিঁড়ির মুখে লোহার গেটে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে অগ্নিকাণ্ডের সময় শ্রমিকরা বের হতে পারে না। আর জলন্ত কয়লা হয়ে বের হয় কেবল তাদের লাশ। অতীতে গাজীপুরের গরীব অ্যান্ড গরীব সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগার তদন্ত রিপোর্টে দেখা গেছে যে, আগুল লাগার সময় সিঁড়ির মুখে গেট বন্ধ থাকায় শ্রমিকরা বের হতে পারেনি। ঠিক একি বিষয়ের পুনরাবৃত্তি হয়েছে সম্প্রতি অগ্নিকাণ্ডের শিকার তাজরীন পোশাক কারখানায়। পত্রিকা মারফত জানা যায় যে, আগুন লাগা তাজরীন ফ্যাশনের এক নারী কর্মী বলেছেন, 'আমাগো বাহির হইতে দ্যায় নাই।'(সুত্র: প্রথম আলো)।

প্রশ্ন হল কেন আগুন লাগার পরও সদর দরজায় তালা লাগিয়ে দেবার মত ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে বারবার? কেন সদর দরজায় তালা লাগিয়ে শ্রমিকদের পুড়িয়ে মারার মত ঘটনা ঘটে বারবার ?

তাই জোরালো দাবি জানানোর এখনই সময়, শ্রমিকের নিরাপত্তা প্রশ্নে মালিকপক্ষকে কোনরূপ ছাড় দেয়া যাবে না। দরকার হলে প্রতিটি কারখানা কিছুদিন বন্ধ রেখেও অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা স্থাপন জরুরী। অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা স্থাপনের সময় কারখানা বন্ধ রাখতে হলে প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিকদের যাতে বেতন- ভাতা বন্ধ না হয় সেদিকে অবশ্যই সরকারের করা নজরদারি আবশ্যক। যে শ্রমিকের রক্ত ঘামে আমাদের দেশ এগিয়ে চলছে, দিনের পর দিন যে শ্রমিকেরা জীবনবাজি রেখে সেলাই মেশিন তথা আমাদের অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখে চলেছেন, সে শ্রমিকের জান বাঁচানো দরকার সবার আগে।

সুত্র: বিজিএমই এবং বিভিন্ন সংবাদপত্র থেকে নেয়া।