আইএমএফ এর চাপে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি: মূল্যস্ফীতি ও জনদুর্ভোগ

জিনিয়া
Published : 6 Dec 2012, 05:36 PM
Updated : 6 Dec 2012, 05:36 PM

গত ৩ ডিসেম্বর বিডি নিউজ ২৪ এর সংবাদ মারফত আমরা জেনেছি যে, অন্যতম ঋণ দাতা সংস্থা আইএমএফ এর সাথে অর্থ মন্ত্রলায়ের বহু দেনদরবারের পর তাদের দেয় প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বর্ধিত ঋণ সুবিধা তহবিলের মোট ১০০ কোটি ডলারের দ্বিতীয় কিস্তির ১৪ কোটি ১০ লাখ ডলার আগামী বছরের জানুয়ারি মাসে পাওয়া যেতে পারে। মূলত ১০০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করা হয়েছিল দেশের আর্থিক খাতে গতিশীলতা আনা, সম্পদের সংগ্রহ বাড়ানো, সামাজিক ও উন্নয়ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ঘাটতি কমিয়ে আনা, অবকাঠামো উন্নয়ন, রপ্তানিমুখী বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য আর্থিক নীতি, মুদ্রানীতি ও বিনিময় হার, আর্থিক খাত ও বিনিয়োগ খাত এই চারটি খাতে সংস্কার এর জন্য। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রথম কিস্তির ঋণের শর্তানুযায়ী যথাযথ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড না হবার কারণে ভীষণ নাখোশ ছিল দাতা সংস্থাটি।তাদের মান ভাঙ্গিয়ে অর্থ ছাড় নিতে মরিয়া আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে অনেক ইংরেজি বাক্য ব্যয় করতে হয়েছে এবং অবশেষে তিনিই বিজয়ীর হাসি হেসেছেন।

ঋণের জন্য অর্থ মন্ত্রী তথা সরকারের মরিয়া হবার অন্যতম কারণ হল, আমাদের প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ জ্বালানী তেল ছাড়াও বিভিন্ন পণ্য আমদানি করতে হয়। আর এই জ্বালানী তেল আমদানির জন্য সরকারকে প্রচুর ভর্তুকি দিতে হয়। এছাড়াও বিদ্যুতের ঘাটতি কমাতে ছোট ছোট বিদ্যুত্ কেন্দ্রগুলো চালাতে ও কৃষিকাজে উত্পাদন অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে সেচ কার্যের জন্য জ্বালানী ভর্তুকি দেয়া হয়। কারণ এসব খাতে ভর্তুকি না দিলে উত্পাদন খরচ বেড়ে যায়। উত্পাদন খরচ বেড়ে গেলে স্বাভাবিকভাবেই জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। রপ্তানি মূলক শিল্পের ক্ষেত্রে উত্পাদন খরচ বেড়ে যাওয়া কখনোই কোনও দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য কাঙ্খিত নয়। এর ফলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকাজের গতি শ্লথ হয়ে পড়ে।

যেহেতু আমাদের রপ্তানি আয় কম আর আমদানি ব্যয় বেশি, কাজেই লেনদেনের এ ভারসাম্য রক্ষার জন্য সরকার আইএমএফ এর ঋণ পেতে বহু দেন দরবার করে এসেছিল গত এক বছরের বেশি সময় ধরে।

অন্যদিকে আইএমএফ জ্বালানী আমদানীতে ভর্তুকি বন্ধ সহ বিদ্যুৎ ও সারের দাম সমন্বয়ের জন্য সরকারকে চাপ দিয়ে আসছিল। আইএমএফকে সন্তুষ্ট করে ঋণের টাকা পেতে সরকারও গত এক বছরে কয়েক দফা জ্বালানির দাম বাড়ায়। এত কিছু করেও আইএমএফ এর সন্তুষ্টি পেতে সরকার ব্যর্থ হয়। অবশেষে অর্থমন্ত্রী পুনরায় জ্বালানির দাম বাড়ানোর পক্ষে সম্মত হলে আইএমএফ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি দিতে রাজি হয় (সুত্র: বিডি নিউজ ২৪, ৩ ডিসেম্বর)।

জ্বালানী তেলের দাম বাড়ানোর গন্ধ পেলেই আমাদের দেশে খুব দ্রুত কিছু পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। তাহলো, বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়বে, যেকোনো ধরনের শিল্পোৎপাদন ও কৃষির উৎপাদন খরচ ও পরিবহন ব্যয় বাড়বে। এর ফলে জনগণের জীবন যাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে বহুগুন।

দফায় দফায় জ্বালানির দাম বাড়িয়ে ও ঋণের টাকায় দেশ চালিয়ে এ সমস্যার সমাধান কখনোই সম্ভব নয়। এ সমস্যার সমাধানের জন্য সরকারকে অবশ্যই বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।নিতে হবে দীর্ঘ মেয়াদী ও কার্যকরী পরিকল্পনা। যেহেতু আমাদের সরকার সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি দিয়ে থাকে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে। কাজেই আমাদের বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকে প্রাধান্য দেয়া দরকার সবার আগে। কুইক রেণ্টালের গুণগান গেয়ে যতই সরকার নাচানাচি করুক না কেন, এতে মূলত সরকারের জ্বালানি তেল আমদানির খরচ ও ভর্তুকির পরিমাণও অনেক বেড়ে যায়। আর তা দ্বারা সাময়িক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা ডিজইনভেস্টমেন্ট হিসেবেই গণ্য হয়। আর এই স্বল্প সময়ে অতি মুনাফা লাভের ফলাফল বাজারে দ্রব্য মূল্যের আগুন দাম থেকেই জনগণ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।

অন্যদিকে সরকার সেচ কার্যে ভর্তুকি দিলেও কৃষকের উত্পাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় সে সুফল মূলত বৃহত্ জনগণের কেউই ভোগ করতে পড়ছে না। উপরন্তু বাজার ব্যবস্থার সমন্বয়ের অভাবে নিজেদের উত্পাদিত পণ্য বহু গুণ দাম দিয়ে কিনতে গিয়ে জনগণ চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারকে বাজার ব্যবস্থা উন্নয়নে নজর দিতে হবে। দাম ঠিক রাখার জন্য প্রয়োজনে অতিরিক্ত পণ্যের রপ্তানি বাজার তৈরি করতে হবে। মধ্য সত্ব ভোগীদের কঠোরভাবে দমন না করলে কোনভাবেই সরকারের কোনও ভাল পরিকল্পনাই কখনো বাস্তবায়িত হবে না, এ বিষয়টি সরকারকে অবশ্যই আমলে নিতে হবে।

যেহেতু জ্বালানী বাড়ার খবর পেয়েই পরিবহন ব্যয় বেড়ে যায় কয়েকগুন, সেক্ষেত্রে পরিবহন ব্যয় বাড়ার সাথে সাথে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। আর একবার কোনও কিছুর দাম বেড়ে গেলে তা পুনরায় কমার রেকর্ড আমাদের দেশে নাই বললেই চলে। হাজার আইন কানুন কিছুই তোয়াক্কা করে না পরিবহন মালিকরা ও ব্যবসায়ীরা। কাজেই জ্বালানী তেলের ভর্তুকি কমিয়ে জনগণের কাছে দাম বাড়িয়ে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের জন্য আগামী দিনগুলোতে বিশাল এক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিবে। এ কথা তো বলাইবাহুল্য জ্বালানির দাম বৃদ্ধির সামগ্রিক চরম প্রভাব পড়বে খেটে খাওয়া জনগনদের উপরেই।

তথ্য ও ছবিসুত্র: বিডিনিউজ ২৪।