মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়া ভাস্কর্য নির্মানে বিপক্ষের অশুভ চক্রান্ত রুখে দাও

জিনিয়া
Published : 10 Jan 2013, 07:01 PM
Updated : 10 Jan 2013, 07:01 PM

সিলেটে অবস্থিত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতার খবর আমার কলিগদের কাছে শুনে আসছিলাম গত কয়দিন ধরে। খবর পেয়েছি শিক্ষকদের একটি অংশ লিখিতভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে যেন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে কোনও ভাস্কর্য নির্মিত না হয়। আমার কিছুটা অবাক হবার পালা। কেননা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এমন নয় যে এই প্রথম কোনও ভাস্কর্য নির্মিত হচ্ছে। এই তো কিছুদিন আগে গত ৩০ জুলাই ২০১১, মহা আড়ম্বরে উদ্বোধন হল 'চেতনা ৭১' । মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে এবং তাদের অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি ভাস্কর্য। মৌলবাদী গোষ্ঠীর বাঁধা উপেক্ষা করে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ক্যাম্পাসের A বিল্ডিংয়ের উত্তর পার্শ্বে নির্মিত 'চেতনা ৭১' ভাস্কর্যটি বৃহত্তর সিলেটে নির্মিত প্রথম ভাস্কর্যের মর্যাদা পয়েছে। ভাস্কর্যটিতে একজন ছাত্র আমাদের জাতীয় পতাকা গর্ব ভরে উচু করে ধরে রেখেছেন আর একজন ছাত্রী আকড়ে রেখেছেন একটি বই, যা বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতীক নির্দেশ করে।

চেতনা ৭১ নির্মাণের অনেক আগে থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করে এমন একটি ভাস্কর্য বা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি করে আসছিল সাধারণ ছাত্রছাত্রী ও প্রগতিশীল শিক্ষকেরা। সকলের দাবিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯৯৭ সালে ক্যাম্পাসের গোলচত্বরে স্মৃতিস্থম্ভের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেছিলেন তৎকালীন স্পীকার মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। কিন্তু প্রশাসনের দীর্ঘসূত্রীতা ও অদৃশ্য শক্তির চাপে দীর্ঘ এক যুগের বেশি কাল ধরে তা আর নির্মাণ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এরপর সকলের প্রাণের দাবির মুখে গত ১৪৯তম সিন্ডিকেট সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্থম্ভ নির্মানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ভাস্কর্য নির্মাণে আবারও বাঁধার মুখে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। জানা যায়,বর্তমানে প্রস্তাবিত ভাস্কর্যটি নির্মাণে প্রগতিশীল শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা পক্ষে অবস্থান করলেও স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী গোষ্ঠী শিক্ষকদের একাংশ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিরোধীতাকারী মাত্র ৫১ জন্য শিক্ষকের সাথে যুক্ত হয়েছেন সিলেটের ওলামা-মাশায়েখরা। ভাস্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে মৌলবাদী চক্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ৭২ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়েছেন। বেঁধে দেয়া আল্টিমেটাম এর শেষদিন আজ বৃহস্পতিবার (১০ জানুয়ারী ২০১৩)।

ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতার কারণ হিসেবে এর বিপক্ষের শক্তি উল্লেখ করেন যে, আধ্যাত্মিক রাজধানী খ্যাত পীর-মুর্শিদের চরণ-মাখা সিলেটে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি নির্মাণ করা যাবে না। কিন্তু প্রশ্ন হল ভাস্কর্য নির্মাণ যদি পীর-মুর্শিদের চরণ-মাখা স্থানে করা না যায়, তবে পীর মাজারকে সমর্থন করে এমন কোনও কিছু আমাদের পবিত্র ধর্ম গ্রন্থের কোথাও আছে কী না? পীরের মাজার এর নামে ভক্তি শ্রদ্ধা করাও তো ইসলামে নিষেধ আছে। সিলেটে পীর আউলিয়ার মাজার আছে বলেই কী তা পুণ্যভূমি? বাংলাদেশে যেখানে পীর-আউলিয়ার পদধূলি পড়ে নাই সেগুলো তবে কী? স্বাধীনতার চেতনা রক্ষা করার জন্য তো বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে, এমনকি পীর আউলিয়া এর স্মৃতি বিজড়িত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও। তবে সিলেটে নয় কেন? তাছাড়া সিলেটে তো একটি ভাস্কর্য ইতোমধ্যে স্থাপিত হয়েছে, তবে এবার কেন বিরোধিতা করা হচ্ছে?

ভাস্কর্যকে মূর্তি বানিয়ে তা পূজা করার খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে তাতিয়ে দেয়া হচ্ছে সিলেটের সাধারণ জনগণকে। পরিকল্পিতভাবে উত্তপ্ত করা হচ্ছে সিলেট তথা পুরো দেশকে।মৌলবাদী চক্র বিশ্ববিদ্যালয় অচল করে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে। হয়তো উগ্র ধর্ম ব্যবসায়ীদের নির্দেশে অতি শীঘ্রই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের কোনও শিক্ষক কিংবা সম্ভামনাময় কোনও ছাত্রের লাশ পড়বে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে, পীর আউলিয়া নিয়ে ব্যবসা করা মৌলবাদী শক্তি চিরতরে থামিয়ে দেবে ভাস্কর্য নির্মাণের প্রচেষ্টা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের এই সময় হঠাত্ ভাস্কর্য নির্মাণ ইস্যু নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি যেন সংঘটিত হবার চক্রে মেতে উঠছে।

জানিনা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মাথা নুয়ে তাদের দাবি মেনে নিবে কী না, নাকি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মত সকলকে সঙ্গে নিয়ে সাহসী হয়ে রুখে দেবে মৌলবাদীদের অশুভ চক্রান্ত। সব বাঁধা ঠেলে নির্মিত হবে মমতাময়ী সাহসিনী মা যিনি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে প্রিয় এই দেশটিকে স্বাধীন করতে আশীর্বাদ করছেন তাঁর কলিজার টুকরা সাহসী ছেলেকে। আশীর্বাদ করছেন তাঁর ছেলে যেন শত্রুর কবল থেকে ছিনিয়ে আনে দেশ মাযের সম্ভ্রম। আর রাইফেল কাঁধে সেই মমতাময়ী মাযের সাহসী আত্মপ্রত্যয়ী ছেলেটির সর্বাঙ্গে যেন বিজয় ছিনিয়ে আনার দৃঢ় প্রত্যয়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ছেলেটি মাযের বুকে ফিরে এসেছিল কী আসে নি ভাস্কর্যে তা জানা না গেলেও আমরা জানি তাঁর সাহসিকতার জন্যই দেশ স্বাধীন হয়েছিল, শত্রুর কবল থেকে সে ছিনিয়ে এনেছিল কাঙ্খিত বিজয়। আমরা কী পারিনা সবাই একজোট হয়ে ভাস্কর্যের ওই বীর মুক্তিযোদ্ধার মত সকল মৌলবাদীদের রুখে দিতে? পারিনা কী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে অমর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর ভাস্কর্য নির্মাণে আমাদের কন্ঠকে যুক্ত করতে?

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জয় হোক, মৌলবাদী স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি নিপাত যাক।