বাংলার সমৃদ্ধি: নাবিক হাদিসুরের মৃত্যুর দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারে?

লুৎফর রহমান সোহাগলুৎফর রহমান সোহাগ
Published : 19 Feb 2012, 05:49 PM
Updated : 6 March 2022, 11:29 AM

দোসরা মার্চ, বুধবার। রাতে অফিস। রাত তখন প্রায় সাড়ে নয়টা। বাসা ছাড়ার প্রস্তুতির মধ্যেই হোয়াটসঅ্যাপে অডিও বার্তা এলো। ইউক্রেইনের অলভিয়া সমুদ্র বন্দরে আটকে থাকা জাহাজের নাবিকদের মরিয়া কণ্ঠস্বর, জাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছে। ভয়ংকর কিছু হতে যাচ্ছে ভেবে প্রায় ৭ হাজার কিলোমিটার দূরের বাংলাদেশে নিজেদের অবস্থার বার্তা পাঠানোর প্রাণান্ত চেষ্টা সেই অডিওতে।

কিছুক্ষণ পর ভিডিওচিত্রও এলো। আগুন নেভাতে জানপ্রাণ দিয়ে লড়ছেন নাবিকরা। সে চেষ্টায় আগুন নিভলো। এরপর জানা গেল ইউক্রেইনে সন্ধ্যা নামার আগেই তাদের সহকর্মী হাদিসুর রহমানের জীবন প্রদীপ নিভে গেছে। সরাসরি গোলার আঘাতে ওই প্রকৌশলী চলে গেছেন বেঁচে থাকার লড়াইয়ের ওপাড়ে।

ইউক্রেইন এখন বিধ্বস্ত। রাশিয়ার আগ্রাসনের পর সেখানকার মানুষ দুঃসহ দিন পার করছে। প্রতিদিনই অসংখ্য জীবন নিহতের সংখ্যায় যোগ হচ্ছে। এরপরও প্রকৌশলী হাদিসুরের এই পরিণতি লেখা কি প্রত্যাশিত ছিল? এই মৃত্যু ঠেকাতে কি কিছু করার ছিল না? ঘটনার আগে-পরের বাস্তবতা এসব প্রশ্ন তুলতে বাধ্য।

ইউক্রেইন ঘিরে মস্কোর সামরিক প্রস্তুতি চলছিল কয়েক মাস ধরেই। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পাশের দেশে হামলা চালানোর নির্দেশ দিবেন, নিশ্চিত করেই এমন গোয়েন্দা তথ্য আসছিল। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে তা যেন চূড়ান্ত হয়েই ধরা দেয়।

নাগরিকদের ইউক্রেইন ছাড়ার নির্দেশ দিতে শুরু করে বিভিন্ন দেশ। কিয়েভ ছাড়তে থাকেন কূটনীতিকরা। ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশও নাগরিকদের ইউক্রেইন ছাড়ার পরামর্শ দেয়। তারও এক সপ্তাহ পর আমরা আশ্চর্য হয়ে জানলাম, ওয়ার জোন এলাকায় গিয়েছে বাংলাদেশের জাহাজ 'বাংলার সমৃদ্ধি'। রাশিয়ার আক্রমণ তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র, ইউক্রেইনের পূর্বাঞ্চলের দুই অঞ্চলকে স্বীকৃতি দিয়ে সেনা পাঠানোর নির্দেশও দিয়ে দিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন।

বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের জাহাজটি ২৯ জন নাবিক নিয়ে অলভিয়া সমুদ্র বন্দরে যায় ২৩শে ফেব্রুয়ারি রাতে। সেখান থেকে পণ্য নিয়ে জাহাজটির ইতালিতে যাওয়ার কথা ছিল। পণ্য জাহাজে তোলার এই প্রক্রিয়া কমপক্ষে এক সপ্তাহের সময় সাপেক্ষ। তার আগেই যা হওয়ার পূর্বাভাস ছিল তাই হয়েছে, ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে ইউক্রেইনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। সমুদ্র বন্দরেই আটকে পড়লেন নাবিকরা।

প্রশ্ন হলো, এই পরিস্থিতিতে তুরস্ক থেকে জাহাজটি কেন ইউক্রেইন পাঠানো হলো? নাবিকদের জীবনকে কেন গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি? শিপিং করপোরেশনের বক্তব্য অনুযায়ী, জাহাজটি যেহেতু ডেনমার্কের একটি কোম্পানির হয়ে ভাড়ায় চলছিল সেক্ষেত্রে তাদের চাহিদাই ছিল বিবেচনার বিষয়। কিন্তু ইউক্রেইন-রাশিয়ার সংঘাত তো হঠাৎ করে এসে হাজির হয়নি। সেক্ষেত্রে ডেনমার্কের ওই কোম্পানির সাথে আলোচনা করে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে না পারা কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতাকেই সামনে আনছে।

আর ভুল পদক্ষেপের খেসারত দিতে হয়েছে নাবিকদের। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে তাদের আটকে থাকতে হয়েছে সমুদ্র বন্দরে। পেশাগত কারণে এই নাবিকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছিল। প্রাণভয়ে থাকা নাবিকরা উৎকণ্ঠিত বার্তা পাঠাতে থাকেন। গণমাধ্যমে এসব বার্তা আসার পর তা কর্তৃপক্ষ যে ভালভাবে নেয়নি তার আঁচও পাওয়া যাচ্ছিল। কারণ ভাবমূর্তি, যা নাবিকদের জীবনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

এই নাবিকদের সামনে দুটি পথ ছিল। প্রথমত, নিরাপত্তার আশ্বাস পেলে জাহাজ নিয়ে ফিরে আসা; যুদ্ধের মধ্যে যা অনেকটা কঠিন। বিকল্প পথটি ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ, জাহাজ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়া। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে নাবিকরা বারবার দাবি জানিয়েছেন। কৃষ্ণ সাগরের তীর থেকে আসা সেই আকুতি আমাদের ছুঁয়ে গেছে। কারণ নাবিকরা অলভিয়া বন্দরকে নিরাপদ মনে করছিলেন না। কিন্তু বাংলাদেশে থাকা কর্মকর্তারা হয়তো এই উদ্বেগকে বেশি গুরুত্ব দিতে চাননি। তারা দাবি করছিলেন, নাবিকরা নিরাপদেই আছে।

কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যে দুঃখজনকভাবে নাবিকদের শঙ্কাই সত্য হলো। তারা বলে আসছিলেন যে, জাহাজে হামলা হবে এমন বার্তা তারা পাচ্ছেন। এবং ভিডিও ফুটেজে আমরা দেখলাম, জাহাজটি লক্ষ্য করেই ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হলো। তখনই প্রশ্ন আসে, প্রকৌশলী হাদিসুরের মৃত্যুর জন্য দায়ী কারা?

এই ঘটনায় বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের নাবিকদের নিরাপদে থাকার দাবি হাস্যকর প্রমাণিত হলো। হামলার পরও তারা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, জাহাজেই নাবিকরা নিরাপদ আছে। তাদের বক্তব্যে এই সন্দেহ আসা অমূলক নয় যে- নাবিকদের নিরাপত্তা নাকি জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল?

এক সপ্তাহেও নাবিকদের উদ্ধার না করার পেছনে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটির যুক্তি ছিল- চারপাশের এলাকা নিরাপদ নয়, সেজন্য নাবিকদের অন্য কোথাও পাঠানো যাচ্ছে না। অথচ, যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরগুলো থেকে দলে দলে মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে গিয়েছেন। বাংলাদেশের অসংখ্য নাগরিকও যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেইন ছেড়েছেন। দেশত্যাগী মানুষের চাপে সীমান্ত সড়কগুলোতে দীর্ঘ যানজট থাকায় অনেকে ৩০-৪০ কিলোমিটার এলাকা হেঁটেও গিয়েছেন। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়দিনে ১০ লাখ শরণার্থী ইউক্রেইন ছেড়েছেন। ইউক্রেইন ছাড়তে তাদের সামনে নিরাপত্তার সংকট প্রকট হয়নি। প্রয়োজন ছিল সঠিক সিদ্ধান্তের, দুর্ভাগ্যজনকভাবে নাবিকদের ক্ষেত্রে যা আমরা দেখতে পাইনি।

নিরাপত্তার ঝুঁকি দেখিয়ে নাবিকদের সরিয়ে নেওয়া যতটা কঠিন বলা হচ্ছিল, বাস্তবতা যে তার চেয়ে ভিন্ন তার প্রমাণ পাওয়া গেল হামলার একদিনের মধ্যেই। সরকারের তৎপরতায় জাহাজ থেকে নাবিকদের উদ্ধার করা হয়েছে পরদিনই। প্রত্যাশিত ঘটনাটি অবশেষে ঘটেছে, কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাস্তবিক সিদ্ধান্তটি এসেছে একজন নাবিকের প্রাণের বিনিময়ে। সরকারের টনক নড়েছে একটি পরিবারের পাহাড়সম বেদনার ভার নেওয়ার পর।

এর আগে নাবিকরা অনেকটা 'আর্তনাদ' করে তাদের উদ্ধারের কথা বললেও শিপিং করপোরেশন ছাড়া সরকারের কাউকে এ বিষয়ে তৎপর দেখা যায়নি। প্রতিক্রিয়াহীন বাস্তবতা তাদের ঠেলে দিয়েছে ভয়ংকর পরিণতির দিকে। জাহাজে হামলার রাতে শিপিং করপোরেশন সিদ্ধান্ত নেয় বিষয়টি নিয়ে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা করার। এরপর সরকারের প্রতিমন্ত্রীদের সরব হতে দেখা যায়। তারা জানান, উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনাও দিয়েছেন। এসব ঘটনাপ্রবাহে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, হাদিসুরের মৃত্যুর আগে সরকারের কোন কর্তৃপক্ষ নাবিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন মনে করেনি।

তাহলে কি প্রকৌশলী হাদিসুরের মৃত্যুকে রাষ্ট্রীয় অবহেলা বলা যাবে? এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক এই কারণে যে- বাংলাদেশ একদিনের মধ্যে নাবিকদের উদ্ধার করতে পেরেছে। এটি অবশ্যই প্রশংসার। একইসাথে প্রশ্নটা বড় হয়ে উঠছে- এই তড়িৎ তৎপরতা আগে নিলে কি হাদিসুরকে বাঁচানো যেত? নাবিকদের উদ্ধার কি সত্যিই কঠিন কিছু ছিল?

প্রশ্নগুলো তোলা জরুরী ভবিষ্যতের জন্য। যদিও সর্বংসহা এই দেশে আমরা প্রশ্ন করতে ভুলে গেছি। কিন্তু প্রশ্নহীন অন্যায়গুলো চলতে থাকলে এমন আরও হাদিসুরকে প্রাণ দিতে হবে নীতি-নির্ধারকদের দূরদর্শীতার অভাবে, মানবিক পদক্ষেপের অভাবে।

যুদ্ধ শুরুই হয় ক্ষত তৈরি করতে, কিন্তু কিছু ক্ষত মেনে নেওয়ার নয়। অনাকাঙ্খিতভাবে সহকর্মী হারানোর সে ক্ষত নিয়েই নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়েছেন 'বাংলার সমৃদ্ধি'র ২৮ জন নাবিক। ইউক্রেইন সংকট যে মানবিক বিপর্যয় তৈরি করেছে, হাদিসুরের মৃত্যু তার সরাসরি আঘাত হিসেবে আমাদেরও তাড়িয়ে বেড়াবে।