মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষতা

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 20 Feb 2012, 05:32 PM
Updated : 26 March 2022, 06:03 PM

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কিছু মূলনীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এর মধ্যে প্রধানতম ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। সেই সময় 'জয় বাংলা' স্লোগান জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে একত্রিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় জয় বাংলা জাতীয় স্লোগানে রূপান্তরিত হয়। 'জয় বাংলা' স্লোগান দিয়েই মুক্তিযোদ্ধারা পাক হানাদার বাহিনীকে মোকাবিলা ও পরাজিত করে।

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ভিত্তি ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, সেখানে 'ধর্মনিরপেক্ষতা'কে চার মূলনীতির একটি নীতি হিসেবে যুক্ত করা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯৭০-এর নির্বাচন এবং পরে মুক্তিযুদ্ধেও জনগোষ্ঠীর একটা অংশ বিরোধিতা করেছিল। ১৯৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রের সেই শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে তখন সামরিক শাসকরা অসাম্প্রদায়িকতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় রাজনীতির বিস্তার ঘটিয়েছেন। চার মূলনীতির মধ্যে 'বাঙালি জাতীয়তাবাদ' নিয়ে শুরু থেকেই কোনো কোনো গোষ্ঠী আপত্তি তোলে। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে যখন সংবিধানে সন্নিবেশিত করা হচ্ছিল, তখনই পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধিরা বললেন যে, তারা বাঙালি নন। এরপর ইসলামপন্থিরাও বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করলেন এবং তারা পাকিস্তানি ধারণা ফেরত আনার চেষ্টা করলেন।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরই সামরিক শাসকেরা রাজনৈতিক সমর্থন জোগাড় করার জন্য এই ইসলামপন্থিদের সঙ্গে নিয়ে কিছু বামপন্থিকে কাছে টানতে শুরু করলেন। তখন ডান-বাম মিলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি তারা নিয়ে এলেন। এ ব্যাপারে মূল ভূমিকা পালন করেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের বদলে আমদানি করলেন 'বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ'। তার সময়ই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ফিরে আসে। সংবিধানে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' যুক্ত করা হয়।

এর ধারাবাহিকতাতেই আরেক সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ সংবিধান সংশোধন করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেছিলেন। তখন রাজনীতিতে এক নতুন 'চেতনা' আমদানি করা হয় তা হলো ভারতবিরোধিতা। "ভারত বিধর্মীদের দেশ, তারা বাংলাদেশকে গ্রাস করতে চায়, মুসলিমদের পদানত করতে চায়"- এমন একটা প্রচারণার মাধ্যমে ভারতবিরোধী রাজনীতি চাঙ্গা করে তোলা হয়। ভারত ও হিন্দু বিরোধিতার রাজনীতি জোরদার হওয়ায় ক্রমেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি মাথাচাড়া দিয়েছে। এবং এই ধর্মনিরপেক্ষতার পথ থেকে আস্তে আস্তে ক্ষমতাসীনরাও সরে গিয়েছে। অথচ স্বাধীন দেশে যে সংবিধান ১৯৭২ সালে প্রণীত হয়েছিল তাতে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার এবং সব ধরনের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি যখন বদলে গেছে, তখন দেশ একেবারে উল্টোপথে হেঁটেছে। যদিও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় সরকারে এসে ৭২- এর সংবিধানের অনেক বিষয় ফেরত এনেছে। কিন্তু 'বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম' এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম౼ এই দুটি বিষয়ে তারা হাত দিতে পারেনি।

বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল দর্শন ছিল বাঙালির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি অর্জন। তিনি রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে বেছে নিয়েছিলেন। এই আদর্শকে তিনি রাষ্ট্রীয় আদর্শেও পরিণত করেছিলেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে রমনার বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মের ভিত্তিতে হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।" এরই আলোকে ১৯৭২-এর সংবিধানে রাষ্ট্রের চার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয় জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে। বাংলাদেশের মতো অনগ্রসর মুসলিমনপ্রধান দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক আদর্শের এই স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

১৯৭২-এর ৪ নভেম্বর গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হওয়ার প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু এক অনন্যসাধারণ ভাষণ দিয়েছিলেন। এই ভাষণে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বলেছেন:

"ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করব না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারও বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম করবে তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেইমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যাভিচার এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলবো ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি।"

বঙ্গবন্ধু একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন একটি গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণ করতে। ১৯৭২-এর ৪ নভেম্বর গণপরিষদের ভাষণে বঙ্গবন্ধু 'গণতন্ত্র' ও 'সমাজতন্ত্র' সম্পর্কেও নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এই ভাষণে তিনি গণতন্ত্র সম্পর্কে বলেছেন:

"আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্র সেই গণতন্ত্র যা সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন করে থাকে। মানুষের একটা ধারণা আছে এবং আগেও আমরা দেখেছি যে, গণতন্ত্র যে সব দেশে চলেছে, দেখা যায় সে সব দেশে গণতন্ত্র পুঁজিপতিদের প্রটেকশন দেওয়ার জন্য কাজ করে এবং সেখানে প্রয়োজন হয় শোষকদের রক্ষা করার জন্যই গণতন্ত্রের ব্যবহার। সে গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা চাই, শোষিতের গণতন্ত্র এবং সেই শোষিতের গণতন্ত্রের অর্থ হলো আমার দেশের যে গণতন্ত্রের বিধিলিপি আছে তাতে সেসব বন্দোবস্ত করা হয়েছে যাতে এদেশের দুঃখী মানুষ রক্ষা পায়, শোষকরা যাতে রক্ষা পায় তার ব্যবস্থা নেই। সেজন্য আমাদের গণতন্ত্রের সঙ্গে অন্যের পার্থক্য আছে। সেটা আইনের অনেক সিডিউলে রাখা হয়েছে, অনেক বিলে রাখা হয়েছে।…অনেক আলোচনা হয়েছে যে, কারোর সম্পত্তি কেউ নিতে পারবে না। সুতরাং নিশ্চয় আমরা কারোর ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হাত দিচ্ছি না। কিন্তু যে চক্র দিয়ে মানুষকে শোষণ করা হয়, সেই চক্রকে আমরা জনগণের কল্যাণের জন্য ব্যবহার করতে চাই। তার জন্য আমরা প্রথমেই ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, কাপড়ের কল, পাট কল, চিনির কারখানা সবকিছু জাতীয়করণ করে ফেলেছি। তার মানে হলো, শোষকগোষ্ঠী যাতে এই গণতন্ত্র ব্যবহার করতে না পারে। শোষিতকে রক্ষা করার জন্য এই গণতন্ত্র ব্যবহার করা হবে। সেজন্য এখানে গণতন্ত্র সম্পর্কে আমাদের সংজ্ঞার সঙ্গে অনেকের সংজ্ঞার পার্থক্য হতে পারে।"

বঙ্গবন্ধু একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক দেশ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই জন্য পর্যাপ্ত সময় তিনি পাননি। গুছিয়ে নেওয়ার আগেই জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর ইতিহাসে অনেক ঘটনা ঘটেছে। নানা ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দল আওয়ামী লীগ কয়েক দফায় ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রাচীনতম দলটি যেন আজ অনেকটাই দিশাহীন, পথহারা। আওয়ামী লীগের নিরুদ্দেশ যাত্রার বর্তমান লগ্নে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ও দলের নীতি-আদর্শের সঙ্গে সংবিধানে বৈপরীত্য লক্ষ করা যাচ্ছে। ফলে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ যে চরিত্র ছিল তার অনেকটাই আজ ক্ষুণ্ন। ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটা এখন রাজনৈতিক কচকচানিতে পরিণত হয়েছে। কারণ চারদিকে এখন ধর্মবাদীদেরই জয়জয়কার। আমাদের দেশের রাজনীতিতে কে কার চেয়ে বেশি ধার্মিক, তার একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যাচ্ছে। মুখে এখনও অনেকে ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ এঁটে থাকলেও আড়ালে জ্বলজ্বল করতে থাকে ধর্মীয় পরিচয়।

গত প্রায় তিন দশক ধরে আমাদের দেশের রাজনীতি এমন ধর্মমুখী পথ ধরেই এগিয়ে চলছে। মুক্তিযুদ্ধের সেই ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা থেকে আমরা অনেক দূর সরে এসেছি। দেশের সকল আইন ও নীতি প্রণয়নে এখন 'শতকরা ৯০ ভাগ মানুষের' অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মপরিচয়কে সামনে টেনে আনা হয়। তাতে করে সংখ্যাগুরুর দাপট দিন দিন তীব্র হয়ে উঠছে। আর সংখ্যালঘুরা ক্রমেই ভাষাহীন, কণ্ঠহীন হয়ে পড়ছেন। অথচ ইতিহাসের শিক্ষা হলো সত্য প্রায়শই সংখ্যালঘুর সঙ্গে থাকে। পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে, এ বক্তব্য দীর্ঘকাল সংখ্যাগুরুর অনুমোদন পায়নি। ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়, গ্যালিলিওর দীর্ঘ কারাবাস হয়। সূর্য কিন্তু পৃথিবীর চারপাশে ঘোরেনি।

গণতন্ত্রের দাবি হলো সংখ্যালঘুর মর্যাদা ও গুরুত্ব রক্ষা করা। শুধু সংখ্যার বিচারে রাষ্ট্রকে 'ধর্মের ষাঁড়' বানালে সংখ্যালঘুরা গুঁতোর ভয়ে কুঁকড়ে থাকবেই। ধর্মের বিভাজন করে সংখ্যালঘুর অবদমন নিশ্চিতরূপে আত্মঘাতী হতে বাধ্য। সংখ্যালঘুর অধিকার খর্ব করে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র কল্যাণরাষ্ট্র হতে পারে না। 'কিলিং দ্য মাইনরিটি' হয়ে উঠতে পারে 'কিলিং দ্য ট্রুথ'।

স্বাধীনতার একান্ন বছর পরে এসেও যদি আমরা এই সত্যটা উপলব্ধি করতে না পারি, তাহলে আর কবে করবো? দেশটা জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ হলে? পুরোপুরি উচ্ছন্নে গেলে?